বৃহস্পতিবার, ৫ মার্চ, ২০২০

111 প্রেমময় আমি আপনাকে ব্যথা প্রশংসা উদ্ধৃতি by Asad Rahman

মার্চ ০৫, ২০২০ 0
111 প্রেমময় আমি আপনাকে ব্যথা প্রশংসা উদ্ধৃতি by Asad Rahman
আপনি কি আপনার উল্লেখযোগ্য অন্যটি মিস করছেন? দুর্ভাগ্যক্রমে, আপনার প্রিয়জনকে বাদ দেওয়া অনেক সম্পর্কের একটি অংশ। আপনি একে অপরকে আবার দেখা না হওয়া পর্যন্ত দিনগুলি সংক্ষিপ্ত করতে আপনাকে সহায়তা করার জন্য আমরা উত্সাহের এই দুর্দান্ত নির্বাচনটি করেছি এবং আমি আন্তরিকভাবে আপনাকে উদ্ধৃতিগুলি মিস করছি। আপনার প্রিয়জন দূরে থাকাকালীন কেন একটি শুভ সকাল বার্তা দিয়ে অবাক করবেন না? যদি আপনার সঙ্গী কোনও ব্যবসায় ভ্রমণে আসে, আপনি যদি দীর্ঘ দূরত্বের সম্পর্কের মধ্যে থাকেন তবে আপনার প্রিয়জন যখন শারীরিকভাবে কাছের না হন তখন খুব চ্যালেঞ্জ হতে পারে। আপনি একা অনুভব করতে পারেন এবং আপনার অর্ধেক থেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করতে পারেন - দেখতে, শুনতে, স্পর্শ করতে এবং গন্ধ পেতে অক্ষম। আপনি যদি আপনার আরও ভাল অর্ধেকের বিষয়ে চিন্তাভাবনা বন্ধ করতে পারেন তবে নীচের উদ্ধৃতিগুলি আপনাকে আবার উত্সাহিত করবে। "তারা বলেছে যে আপনি যখন কাউকে মিস করেন তখন সম্ভবত তারাও একইভাবে অনুভব করেন তবে আমি মনে করি না যে এই মুহুর্তে আমি আপনাকে যতটা মিস করছি ততই আপনি আমাকে মিস করতে পারবেন না।" এডনা সেন্ট ভিনসেন্ট মিল আপনার দুজনকে পরের দুই দিন বা এক সপ্তাহ এমনকি একসাথে থাকতে পারে না তা জেনে বেদনাদায়ক অনুভূতি। পিক্সিল্যাটেড স্কাইপ কল এবং সংক্ষিপ্ত ফোন কলগুলির সাথে বাস্তব জীবনের মিথস্ক্রিয়াগুলি প্রতিস্থাপন করার সময়, মনে হয় যে এটি আপনাকে নেওয়া হয়েছিল এটি আপনার পক্ষে সবচেয়ে মূল্যবান।

সোমবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০২০

চাচাতো বোন যখন বউ/asadrahman

জানুয়ারী ২৭, ২০২০ 0
চাচাতো বোন যখন বউ/asadrahman
চাচাতো বোন যখন বউ" (part:2) কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে গিয়েছিলাম নুসরাতের রুমে, গিয়ে দেখি উনি Tik Tok ভিডিও বানাতে ব্যস্ত...।তাই দরজার সামনে গিয়ে শাহরুখ খানের মতো স্টাইল নিয়ে... এ এ এ "ছোঁওয়াগাত নেহি কারোগি হামারা...? নুসরাত আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে এক মিনিট দাড়া নড়বি না, ছোওয়াগাত করতেছি তকে। তারপর পাশে থেকে একটা জুতা নিয়ে ঠাস করে আমার দিকে ছুরে মারলো। এরপরের বার রুমের সামনে আসলে.. ঝাড়ুছে কারোংগি তেরি ছোওয়াগাত....।এর পর পরই মুখের উপর ধারাম করে দরজা টা বন্ধ করে দিলো ইজ্জত কি ফালুদা বানা দিয়া রে.. ।আশে পাশে ঘুরে দেখলাম কেও আবার দেখে ফেললো নাকি।বলা তো যায় না কে আবার ভিডিও বানিয়ে ফেসবুকে ছেরে দিবে।এ সমস্ত ভিডিও ভাইরাল করতে তো আপনাদের আবার সময় লাগে না.. ।না, আশে পাশে কেউ নেই ভেবে যেই একটা স্বস্তির দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়তে যাবো ঠিক তখনি তাকিয়ে দেখি কাজের মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে ফ্যালফ্যাল করে হাসতেছে।আমি সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম কি হয়েছে হাসতেছো কেন..? কাজের মেয়েঃআমি সব দেখে ফেলেছি দাদা ভাই.. আমিঃএই রে, এইবার ইজ্জত নিলামে উঠবে শিওর।আমাদের কাজের মেয়েটাকে সবাই বি বি এস খবরবার্তা বলে।কারন ও সব কিছু 5G স্পিডে ছড়িয়ে দিতে উস্তাদ। তখন মাথায় ঘুরে ফিরে একটা গানই বাজতেছিলো"লুট গায়া ম্যা লুট গায়া"।ইজ্জতের মায়া ছেরে রুমে গিয়ে ফেসবুক টা লগইন করলাম।আহা কতো সুন্দর সুন্দর মেয়ে আমার ফ্রেন্ডলিস্টে, বিয়ের পর আর এদের সাথে কথা বলতে পারবো না ভেবেই আবেগে বুক হালকা হয়ে গেলে থুক্কু ভারি হয়ে গেলো।এসব কথা চিন্তা করে করে কখন যে ঘুমিয়ে পরলাম বুঝতেই পারলাম না।ঘুম ভাঙতেও বেশী সময়ের প্রয়োজন হলো না,ধারাম করে এক গাদা পানি উড়ে এসে আমার উপরে পরলো। তাকিয়ে দেখি নুসরাত। আমিঃএগুলার মানে কি...? নুসরাতঃতর জন্য চা এনেছি... আমি:চা এনেছিস ভালো কথা তাই বলে এ ভাবে ঘুম ভাঙাবি..?দে.... নুসরাত: কি..? আমি: চা টা দে.. নুসরাতঃএই নে আমি একটু মুখে দিয়ে... আমি:বেআক্কেল মেয়ে ১৮ বছর হয়ে গেছে এখনো লবন আর চিনির পার্থক্য বুঝস না।চায়ে লবন না,চিনি দিতে হয় এ গুলা কেও তকে শিখায় নাই..? নুসরাত:চায়ে লবন ইচ্ছা করেই দিছি। এখন থেকে এগুলাই তর কপালে আছে।যতো তাড়াতাড়ি অভ্যাস করতে পারবি তর জন্য ততোই ভালো...বায় এখন ঘুমিয়ে থাক। আজব মাইয়া।পানি দিয়ে গোসল করিয়ে এখন বলে ঘুমিয়ে থাক।কি আর করার ভেজা শরিরে তো আর থাকা যাচ্ছে না তাই সকাল সকাল গোসল টা করেই ফেললাম। শীতের সকালে গোসল করার স্বাদ একমাত্র স্কুলের ছাত্র ছাত্রীরাই বলতে পারবে।এমন ভাবে কাপতেছিলাম মনে হচ্ছিলো শরিরের প্রতিটা পেশিকোষে কেও ১১০০০ হাজার বোল্ডের বিদ্যুৎ এর শক দিতেছে। রেডি হয়ে নিচে চলে গেলাম নাস্তা করতে। হঠাৎ ফোন আসলো মেঝু চাচা,মেঝুচাচি দেশে আসতেছে।তাদের আনতে বিমানবন্দরে যেতে হবে। দুপুরের খাবার খেয়ে ছোট চাচাতো ভাই টাকে নিয়ে রওনা হয়ে গেলাম।কিছু সমস্যার জন্য চাচা-চাচির ফ্লাইট ৩ ঘন্টা পিছিয়ে গেছে।কি আর করার, গাড়িতে বসে টিভি দেখে সময় পার করে দিলাম।অত:পর ১০:৪০ এ চাচা চাচি কে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম এবং ১১:৫৫ তে বাসায় পৌছে গেলাম।বাসায় গিয়ে মোবাইল চার্জদিতে গিয়ে দেখি চার্জার গায়েব।কে গায়েব করেছে তা এখন ভাবার সময় নেই,বউয়ের অবস্থা খারাপ যে কোন সময় দম বের হয়ে যাবে মাত্র ৩% চার্জ আছে।হঠাৎ মাথায় আসলো নুসরাতের দুইটা চার্জার একটা সিস্টেম করতে পারলেই আমার কাজ চলে যাবে।চোরের মতো নুসরাতে ঘড়ে প্রবেশ করে যেই চার্জার আনতে গেছি আর তখনি নুসরাত চলে এসেছে..।জান বাচাতে দিলাম অলম্পিকে ৮০০ মিটারের দৌড়, পায়ে লেগে নুসরাতের রাঙামাটি থেকে আনানো শখের ফুলেরটব টা ভেঙে চৌচির হয়ে গেলো।ভয়ে আমার হার্ট টা যেন বের হয়ে আসতেছিলো।বুঝতে পারতেছেন ধরতে পারলে ও আমার কি হালটাই না করবে...জান বাচাতে ছাদে গিয়ে পালাইছিলাম কিন্তু নুসরাত তো নাছোড়বান্দা জানে আমি ভূত কে অনেক ভয় পাই তাই আমাকে কিছু না বলে, চিলেকোঠার দরজাটাই লক করে দিয়ে গেছে। যাওয়ার সময় আবার বলে গেছে বেস্ট অব লাক।এখন আমি ছাদে বসে গল্প লেখতেছি।দোয়া করবেন বেচে থাকলে পরের পর্বদিবো। .

বুধবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০২০

হঠাৎ দেখা ২০২০

জানুয়ারী ১৫, ২০২০ 0
হঠাৎ দেখা ২০২০
০১. সেদিন দেখেছিলুম লাল বেনারসিতে, চোখে ছিল গাঢ় কাজল, মাথার চুলে ছিল সোনার টিকলি। বেনারসির আচঁলটা ঘোমটা দিয়ে তুলা ছিল মাথায়। বেশ মানিয়েছিলো তাকে। একবার তাকালে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝলুম এত আয়োজনের মধ্যেও দৃষ্টিতে তার আগুন ঝরা শূন্যতা, সেই শূন্যতায় মুরুভূমির মতো তৃষ্ণার্ত চোখ দুটো কিসের অপেক্ষায় ডেবে গিয়েছে ভেতরে, অদূরে চেয়ে আছে দিগন্তের লাল রঙের দিকে । সেই অঙ্কিতা, যাকে দেখেছিলুম লাল বেনারসিতে, কপালে আঁকা ছিল টিপ; মাথায় তুলা ছিলো লাল বেনারসির ঘোমটা, তাকে আজ দেখলুম বিধবার সাদা শাড়িতে ! কেমন যেন বড্ড বেমানান লাগছে চোখে। আগের থেকে শুকিয়ে গেছে অনেক, চোখের নিচে পড়েছে কালি, বয়সের ছাপ পড়েছে ভাজ পড়া চামড়ার ভেতরে । সেই চোখ, মুখ, নাক, পাতলা ঠোঁটের একপাশের কালো তিলটাও: সবকিছু আগের মতোই আছে, একটুও বদলায় নি। চুলগুলোও ঠিক আগের মতো আছে, শুধু কপালের সামনের কয়েকগাছি চুলে পাক ধরেছে। প্রথমেই তাকালুম চোখের দিকে: দৃষ্টিতে সেদিনের আগুন ঝরা শূন্যতা আর নেই। সেদিনের দৃষ্টির আড়ালের শূন্যতায় অপেক্ষা ছিলো, হয়তো অপেক্ষার আড়লে তিল তিল করে জমিয়ে রাখা আশাও ছিলো। আজ এত বছর পর সেই চোখের দিকে হঠাৎ তাকিয়ে দেখলুম- সেখানে শূন্যতা আছে ঠিকই, কিন্তু সেই শূন্যতায় আর আগুন ঝরছে না। সেই শূন্যতা কেমন যেন নিস্তব্ধ, নিঃস্পৃহ, নিরব। নেই অপেক্ষা, আশা আর হতাশাও। আজ কত বছর পর দেখা, জানিনে। একসময় না দেখার হিসেবগুলো গুনে গুনে রাখতাম, খাতায় অংক কষার মতো। হিসেব রাখতে রাখতে কখন যে ক্লান্তি ভর করল, বিষণ্ণতা এসে অন্ধকারে ডুবিয়ে দিলো, বুঝতেই পারলুম না। সেই থেকে হিসেব রাখাটা ভুলেছি বহুবছর। আজকের দিনটা বড় মেঘলা, সকাল থেকে ঝির ঝির করে বৃষ্টি পড়ছে ক্লান্তিহীনভাবে। অদূরে লাগানো আমার হাতের রক্তজবা গাছে ফুল ফুটেছে; বৃষ্টির ফোঁটায় কেঁপে কেঁপে ওঠছে তার পাপড়ি। সকালে স্টেশনে ট্রেন আসার কথা ছিলো, সেটা লেট করেছে। সকালের ট্রেন আসবে দুপুরে। আমার কোনো কাজ ছিলো না। বৃষ্টির বাতসের ঝাপটায় ওড়ে আসা গাছের কাঁচা পাতা ছড়িয়ে রয়েছে প্লাটফর্মের যত্রতত্র। ভাবলুম, পাতাগুলো কুড়িয়ে প্লাটফর্মটা পরিষ্কার করে দেই। পাতা কুড়িয়ে প্রায় পরিষ্কার করে ফেলেছি, অমন সময় চোখ পড়ল প্লাটফর্মের এককোণায়। দেখলুম কে যে বসে আছে সাদা আঁচলে ঘোমটা মাথায় । পাশে একটা টিনের বাক্স। শাড়ির আঁচলে মুখটা এমনভাবে ডেকে রেখেছে দেখা যাচ্চেনা। কাছে গিয়ে বললুম, -আপনি ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছেন নাকি? ও শাড়ির আঁচল সড়িয়ে মুখ তুলে তাকালো আমার দিকে। প্রথম দেখাতেই চিনতে পারল নাকি জানিনে। অনেক্ষণ পর ধীরে ধীরে ওঠে দাঁড়াল, মৃদুভাবে কাঁপা গলায় বললে, রুপম…! বললুম, হ্যাঁ । কতক্ষণ যে বিমূঢ়ের মত দাঁড়িয়ে থাকলুম বলতে পারিনা। ও-ই আমাকে প্রশ্ন করল, বললে,- চিনতে পেরছ? ম্লান হেসে বললুম, হ্যাঁ। “কে?” -অঙ্কিতা ! ০২. শ্রাবণের ঘোমুট বাধা অন্ধকারে ঝড়ো বাতাসে একটুকরো ছেঁড়া চিঠির অংশ ওড়ে এসে পড়লে আমার পায়ের কাছে। তখনো কি জানতাম তার দেখা পাওয়া সম্ভব হবে? হায়, আজ কি অবেলায় তার দেখা পেলুম ! আমি জানতাম, কোনো একদিন তার দেখা পাবো; কোনো একদিন : যখন সূর্যটা অস্ত যাবে, ওপারের আকাশে অন্ধকার ঘনিয়ে আসবে, নিমজ্জিত আঁধারে নিজের প্রতিচ্ছবিও যখন দ্যাখতে পাবোনা, তখনো হয়ত তার দেখা পাবো ! আমি জানতাম তার দেখা পাবো! কিন্তু, হায়, এমনভাবে তাকে দেখতে পাবো সেটা কি কখনো কল্পনা করেছিলুম? আমি তাকে কল্পনা করেছিলুম বাসন্তি রঙের শাড়িতে, চোখের নিচে লেপ্টে যাওয়া গাঢ় কাজলে, পাতলা ঠোঁটের কোণায় ফুটে ওঠা এক চিলতে হাসিতে ! হায় নিয়তি, আমি কি তাকে কখনো কল্পনা করেছিলুম, সাদা শাড়িতে? বেদনায় লেপ্টে যাওয়া চোখের নিচের গাঢ় কাজলের লেখাতে? শুকিয়ে যাওয়া মৃত ঠোঁটের এক চিলতে শুষ্ক হাসিতে? কক্ষনো না। কিন্তু নিয়তি হয়ত এভাবেই আমাদের দেখা মিলিয়ে রেখেছিলো। জিজ্ঞেস করলুম, এখানে কি করে আসলে? স্মিতহাস্য মুখে অদূরে চেয়ে বললে, কাজের স্বার্থে কত জায়গা যেতে হয়, এখান আর সেখান বলতে কোনো কথা নেই। “কি কাজ?” “মেয়েদেরকে স্বাবলম্বী করে তুলার কাজ । তাদের কে নিজের পথ চিনিয়ে দেবার কাজ, নিজের আপন স্বত্বাকে ভুলে মেয়েরা নিজেকে খাঁচায় বন্দি পাখির মত করে রেখেচে , তাদের সেই আপন স্বত্বা কে জাগিয়ে তুলার কাজ।” চুপ হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলুম অনেকক্ষণ। বুঝলুম নারী মুক্তির আন্দোলনে সে যোগ দিয়েছে। খানিক পর বললুম-“কবে থেকে এই কাজে আসলে?” “সুজিত চলে যাবার পর।” খানিক থেমে কিছুক্ষণ পর আপন মনেই বলতে থাকলে, সে অনেক বছর হলো। বিয়ের দুবছর পর আমি যখন পাঁচ মাসের অন্তঃস্বত্বা : রোড এক্সিডেন্টে সুজিত মারা পড়লে। শ্বশুর বাড়ির লোক ছিলো পুরোনো ধ্যান ধারণার, অপবাদ দিয়ে বল্লে, অপয়া, রাক্ষুসী। আরো কত কি উপাধি যে নামের সংঙ্গে যুক্ত করলে সেইসবের কথা এখন আর অত মনে পড়ে না। তুমি ভাবছো রাগ করে বুঝি তখন আমি চলে আসলুম। আরে না, ঠিক চলে আসলুম না, বিদেয় করে দিলো। তখন থেকে কি একটা যেনো আমার ভেতরে গজিয়ে ওঠছিলো ধীরে ধীরে, ঠিক বুঝে ওঠতে পারছিলুম না। সেই কি একটা যে আমার ভেতরের আলাদা একটা অংশ: এতদিন চাপা পড়েছিলে আবর্জনায় নিচে, এখন সুযোগ পেতেই অঙ্কুর গজানো শুরু করেছে সেটা বুঝতে আমার ঢের সময় লেগেছিলো। মেয়ে জন্ম নেওয়ার অনেক পড়ে বুঝলুম আমি আর আমি নেই। ঈশ্বর আমাকে নতুন জীবন দেখিয়ে দিলেন, আমিও সেই নতুন জীবনটাই বেচে নিলুম। এই পর্যন্ত বলে চুপ হতে রইল। বুঝলুম, জীবন সংগ্রামে হারতে হারতে জয়ী হয়ে ওঠেছে । নিজের ভেতরে গজিয়ে ওঠা স্বত্বাটা ভেঙে ফেলেছে নিয়ম বাধা সব শেকল। ছুঁড়ে ফেলেছে মুখোশের উপরের আবরণ। শুধু নিজের ভেতরের শেকলটা ভেঙে ফেলে, আবরণটা টেনে ওঠিয়েই ক্রান্ত হয়নি। এখন ভেঙে ফেলতে চাইছে সমাজের পায়ে বাধা শেকল, মুখোশটা ছিড়ে ফেলে দেখিয়ে দিতে চাইছে আসল চেহারা। বললুম, মেয়েও কি তোমার সাথে থাকে? “হ্যাঁ এতদিন সাথেই ছিলো, এখন থাকে না। এলাহাবাদে ওর বিয়ে দিয়েছি বছর তিনেক আগে ।” ০৩. আমার কথা জানতে চাইল। আমি এখানে কিভাবে স্টেশনমাস্টার হলাম? এই ভূতুড়ে জায়গায় কি করছি? এখান থেকে টার্ন্সপার হয়ে অন্যকোথাও চলে যাচ্চিনা কেন? সংক্ষেপে সব প্রশ্নের উত্তর করলাম। কিছুক্ষণ বৃষ্টি থেমে ছিলো, এখন আবার মুষলধারায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ট্রেন আসতে বেশি সময় নেই। হাতে যখন আর মিনিট দশেক সময় আছে, ওকে বসিয়ে রেখে ছুটে গেলাম বাইরে, রক্তজবা গাছটার কাছে। ফুল এসেছে অনেক, ফুলের ভারে গাছটার একটা চিকন ডাল নুয়ে পড়েছে মাটিতে। অনেকগুলো ফুল নিলাম। ভেজা শরীলে ওর হাতে যখন ফুল তুলে দিলাম ও বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলে আমার দিকে। বললুম, তুমি রক্তজবা পছন্দ কর ভুলিনি। স্টেশনের ওধারটায় কয়েকটা গাছ লাগিয়ে ছিলুম অনেক আগে। প্রতি বর্ষাতে অনেক ফুল আসে, তেমনিভাবে ঝড়ে ঝড়ে পড়ে মাটিতে। কুড়িয়ে পর্যন্ত নেবার কেউ নেই। আমি মাঝে মধ্যে গিয়ে শুধু দ্যাখতুম, কখনো ঝড়ে পড়া ফুল কুড়িয়ে তুলতুম, কিন্তু ফিরে আসবার সময় ওভাবেই আবার ফেলে আসতাম । ফুলেরা হয়তো জানতো এই অসময়ে দেখা হয়ে যাবে ! ও আমার দিকে গাঢ় বিষাদভরা চোখে খানিক তাকিয়ে রইলে, ঠোঁটের কোণায় এক চিলতে শুষ্ক হাসির আভাস ফুটিয়ে তুলে বললে, রঙিন কাঁপড় ছেড়েছি সে অনেক বছর হলো; যদি নিজেকে রঙিন করার অভিলাষ মনে পুষে রাখতুম তাহলে জীবনের গাছে রক্তজবা ফুটতো তারও বহু আগে। ০৪. এই নির্জন স্টেশনে ট্রেন আসে, তবে যাত্রী হয়না সবসময়। হঠাৎ হাঠাৎ দু-একজনের দেখা পাওয়া যায়। ট্রেন থামে, ট্রেনে যাত্রী ওঠে, হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন আবার চলে যায়। আবার কখনো যাত্রীশুন্য স্টেশনে ট্রেন আসে, পতাকা নাড়াই, কিন্তু সেদিন আর কেউ ওঠেনা, ট্রেন রীতিমতো গন্তব্যে ছুটে চলে। কিছুক্ষণের জন্য ট্রেনের হুইসেলে গমগম হয়ে ওঠে সারা স্টেশন, ট্রেন চলে গেলে আবার নির্জনতায় ডুবে যায় চারিপাশ। নিস্তব্ধ নিরবতায় খাঁ খাঁ করে দিগন্ত। অঙ্কিতা দাঁড়িয়ে আছে প্লাটফর্মে। পরনে সাদা শাড়ি, হাতে লাল টুকটুকে রক্তজবা। দৃষ্টি দূরের মেঘলা আকাশে নিবদ্ধ। মুষুলধারায় বৃষ্টি পড়ছে, বৃষ্টির শব্দে শুনে ভাবলুম, আকাশটা ফেটে বুঝি চৌচির হয়ে গেছে। বৃষ্টির শব্দে ঢাকা পড়েছে দূরের ট্রেনের হুইসেল। বৃষ্টিতে স্নান করে ধীর শরীলে ট্রেন যখন একেবেঁকে এসে ডুকেছে পাল্টফর্মে ; ও দূরের আকাশ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এনে আমার দিকে ফিরে বললে, -তোমার ছেলে মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করলুম নাতো? তোমার ছেলে মেয়ে কয়টা? “নেই। ” ও কেমন বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইলে। ট্রেনের হাতল ধরে উঠতে যাবে এমনসময় অবিশ্বাসের স্বরে ফের জিজ্ঞেস করলে, -“সত্যি কোনো ছেলে মেয়ে নেই?” মাথা নাড়িয়ে বললুম, – না, নেই। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে, ও বসেছে জানলার পাশে। বাইরে থেকে তার হাতের অংশ দেখা যাচ্ছে। ট্রেনের গতি যখন বেড়ে চলেছে, ও জানলা দিয়ে মাথা বের করে তাকালো। বৃষ্টিতে ভেজে যাচ্ছে তার চুল, সেইদিকে খেয়াল নেই। ট্রেন ছুটে চলছে দ্রুত। হয়তো ওর গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে চোখের জল, বৃষ্টিতে ধুয়ে মুছে যাচ্ছে বহুদিনের জমানো ধূলোবালি। আমি তা অনুভব করলেও দ্যাখতে পাচ্ছিনা । কখন যে বৃষ্টি থেমে গেলো, ট্রেনের হুইসেল থেমে গিয়ে কবে যে দূরে মিলিয়ে গেলো ঠিক বুঝে ওঠতে পারলুম না। বিহ্বলতা কাটিয়ে ওঠতেই দেখি, এক অসহ্য নিরবতা, নিঃসঙ্গতা, নিস্তব্ধতা যেন দিগন্তবিস্তৃত নির্জনতা জুড়ে খাঁ খাঁ করছে। অদূরে লাগানো রক্তজবা গাছটার দিকে তাকিয়ে দেখলুম, তখনো পাপড়ি থেকে জল ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে পড়ছে মাটিতে।
জানুয়ারী ১৫, ২০২০ 0
প্রাক্তন লেখা মোঃআসাদ রহমান কোটচাঁদপুর, ঝিনাইদহ রাশেদ ড্রাইভার করিমকে বলল, গাড়ি সাইডে রাখো। ড্রাইভার গাড়ি সাইড করতেই নেমে গেল রাশেদ। তারপর বলল, তুমি অফিসে চলে যাও। করিমের মনে একটা প্রশ্ন এলো, স্যার, মিটিংয়ে যাবেন না? কিন্তু প্রশ্ন করল না। সে জানে রাশেদ স্যার তার এসব প্রশ্নের জবাব দিবে না বরং মিষ্টি করে একটা হাসি দিবে। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে চোখের আড়াল হতেই রাস্তার পাশে দোকান থেকে সিগারেট ধরিয়ে টানতে শুরু করল রাশেদ। সে তাকিয়ে আছে রাস্তার ওপাশে একটা সাইনবোর্ডের দিকে। সেখানে সুন্দর করে লেখা ‘ডা. মারজিয়া মৌরী, এমবিবিএস, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। রোগী দেখার সময় সোম থেকে বুধ, বিকাল চারটা থেকে রাত নয়টা’। এই নামটা দেখেই গাড়ি থেকে নেমেছিল রাশেদ। এই নামের সাথে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এখনো এই নাম কোথাও লেখা দেখলে বুকের মধ্যে মৃদু একটা ব্যথা অনুভূত হয়। রাশেদ আধখাওয়া সিগারেট ফেলে দিয়ে রাস্তা পার হয়ে ওপাশে চলে গেল। রিসিপশনে গিয়ে সানগ্লাসটা খুলতে খুলতে বলল, ডা. মারজিয়া আছেন? রিসিপশনের ছেলেটা বলল, জ্বি স্যার, আছেন। আপনি কি ভিজিট করতে এসেছেন? -হ্যাঁ। -তাহলে ওখানে বসুন স্যার। আপনার সিরিয়াল এলে আপনাকে বলব। স্টিলের বেঞ্চের উপর বসে বাম পায়ের উপর ডান পা রেখে পা নাচাতে থাকল রাশেদ। প্রায় পনেরো মিনিট ধরে বসে আছে সে। এখনো তার ডাক আসেনি। রাশেদের ঠোঁটের কোণে হাসি। তার মতো একজন গুরুত্বপূর্ণ লোকের এতো সময় থাকে না যে ডাক্তারের সিরিয়াল নিয়ে বসে থাকবে। সে সাধারণত তার পিএসকে দিয়ে সিরিয়াল রাখে। রাশেদ সেখানে গিয়েই ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকে যায়। আর সে যেসব ডাক্তারদের দেখায়, তারা রাশেদকে ততটা গুরুত্বই দেয়। আর এখানে সে বসেবসে পা নাচাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর রাশেদের ডাক এলো। রাশেদ উঠে গিয়ে ডাক্তারের চেম্বারের দিকে গেল। এয়ার কন্ডিশনড রুম। একজন দরজা খুলে দিল। রাশেদ দরজার কাছ থেকেই জিজ্ঞেস করল, ভিতরে আসব? রোগীরা সাধারণত এই ভদ্রতাটুকু দেখায় না। তারা থাকে রোগে শোকে কাতর। ভদ্রতা দেখানোর সময় নেই। ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকেই বলে, ডাক্তার, আমার কী হয়েছে, তাড়াতাড়ি বলেন। রাশেদের প্রশ্ন শুনে ডা. মারজিয়া মৌরী না তাকিয়ে বলল, আসুন। টেবিলের কাছাকাছি আসতেই বলল, বসুন। রাশেদ বসল না। সে তাকিয়ে আছে মৌরীর দিকে। আগের থেকে সামান্য মোটা হয়েছে। গায়ের রঙ কিছুটা উজ্জ্বল হয়েছে। আর চোখে উঠেছে মোটা ফ্রেমের চশমা। মৌরী বলল, কী ব্যাপার দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ব….. কথাটা শেষ করার আগে তাকালো রাশেদের দিকে। মাথায় কাঁচাপাকা চুল। পুরুষ্টু গোঁফ, মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি। কিন্তু চেহারাটা আগের মতো না থাকলেও চিনতে কষ্ট হয়নি। আচ্ছা, ওর কণ্ঠটা কি আগের মতোই আছে? বসতে বসতে রাশেদ জিজ্ঞেস করল, কেমন আছো মৌরী? মৌরী উত্তর দিল না। আগের মতোই মোটা কণ্ঠ। কী সুন্দর স্পষ্ট উচ্চারণ! মৌরী চোখমুখ থেকে বিস্ময় ভাব দূর করে বলল, ভালো। পরক্ষণেই সে বলল, কী সমস্যা আপনার বলুন। বলেই প্রেসক্রিপশনের প্যাড আর কলম নিয়ে রেডি হল ওষুধ লেখার জন্য। রাশেদ হেসে বলল, রাখো তো ওসব। -দেখুন, আপনার সাথে বসে গল্প করার সময় নেই আমার। বাইরে আরও পেশেন্ট বসে আছে। তাদের দেখতে হবে। -সাধারণত মেডিসিন স্পেশালিস্টের কাছে ইমার্জেন্সি পেশেন্ট আসে না। আজকের জন্য নাহয় এই পেশেন্টটাকেই দেখ। -আপনার ন্যাকামি বন্ধ করুন এবং আপনি চলে যান। -প্রায় বিশ বছর পরে দেখা। কিছু কথা না বলে কিভাবে যায়? -আপনি কি যাবেন নাকি আমি দারোয়ান ডেকে বের করে দিব? -বাংলা সিনেমা বেশি বেশি দেখছ নাকি? যাও, ডেকে নিয়ে এসো। তোমার দারোয়ান দেখুক যে তোমার বিশ বছর পুরনো প্রাক্তন প্রেমিক তোমার চেম্বারে বসে আছে। বলেই পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালো রাশেদ। মৌরী দ্রুত গতিতে বের হয়ে গেল চেম্বার থেকে। তার ডাক্তারি পেশার এই দীর্ঘ সময়ে এতটা অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়েনি কখনো। প্রায় দুই মিনিট পর ফিরে এলো সে। ড্রয়ার থেকে একটা সুদর্শন এশট্রে বের করে দিয়ে বলল, এটাতে ছাই ফেলুন। বলেই মৌরী ওয়াশরুমে ঢুকল। ট্যাপ ছাড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। সিগারেট টানতে থাকল রাশেদ। ঠোঁটের কোণে অস্ফুট হাসি। মুখে পানি দিয়েছে মৌরী। মুখ মুছতে মুছতে বলল সে, এতদিন পর কী মনে করে? -মনে তো করি সবসময়। কিন্তু খুঁজে পাইনি কখনো। -আপনি কি এখনো হেঁয়ালি করে কথা বলেন? -না। শুধু তোমার সাথে বলছি। তাই হেঁয়ালিপনাটা পরিপক্ক হচ্ছে না। -তাহলে দয়া করে হেঁয়ালি করা বন্ধ করুন। -বন্ধ করছি। তার আগে দয়া করে তুমি ‘আপনি আপনি’ করে কথা বলাটা বন্ধ কর। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মৌরী। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে পড়ল সে। ইজিচেয়ারটায় দোল খেতে খেতে তাকিয়ে আছে রাশেদের দিকে। চুলদাড়ি পাকা হলেও চেহারার মধ্যে আগের সেই কোমলতা আছে। আগে ঠোঁট ছিল লাল আর এখন হয়েছে কালো। সিগারেটটা কি খুব বেশি খায়? সিগারেট শেষ করে রাশেদ বলল, ভাবতেই পারিনি তোমাকে সত্যিই আবার পেয়ে যাব। -খুঁজেছ কখনো? -হয়তো পাগল প্রেমিকের মতো তোমার বাড়ির সামনে বা কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকিনি। কিন্তু তোমার পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের তো জ্বালিয়েছি তোমার কথা জিজ্ঞেস করে। -তাতে আমার ক্ষতিই হয়েছে। যে বা যারা আমাকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কিছু বলার সাহস পেতো না, তারাও আমার দিকে আঙ্গুল তুলে কথা বলেছে শুধুমাত্র তোমার জন্য। তুমি আমার মায়ের কাছেও ফোন করেছিলে। উল্টাপাল্টা কথা বলেছিলে। -উল্টাপাল্টা বলিনি। তিনি যা জিজ্ঞেস করেছেন তার উত্তর দিয়েছিলাম। -তার উত্তর ভদ্রভাবেও দেওয়া যায়। -মেকি ভদ্রতা দেখানো আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আর তোমাকে হারানোর পর আমি প্রায় পাগল হয়ে গেছিলাম। -কিন্তু তোমার পাগলামিতে একটা মেয়ের ক্ষতি হতে পারে, সেটা কি ভাবোনি? -আমি তোমার কোন ক্ষতি করিনি। -যাক, ও তর্কে যেতে চাই না। চা খাবে? -হুম। খাওয়া যেতে পারে। তোমার পেশেন্টরা কোথায়? -বিদায় করে দিয়েছি। কারণ তুমি আগে যেমন পাগল ছিলে, এখনো সেরকমই আছ। রাশেদ হাসল। বেল টিপে পিয়নকে ডেকে বলল, দুইটা চিনি ছাড়া চা দাও। রাশেদ চোখ বড় করে তাকাল মৌরীর দিকে। জিজ্ঞেস করল, তুমি চিনি ছাড়া চা খাওয়া ধরলে কবে? -তোমার সাথে রিলেশন থাকাকালীন সময়ে মাঝেমধ্যে খেতাম তা তো জানই। -হ্যাঁ। তুমি কত সুন্দর করেই না বলতে ‘এই জঘন্য জিনিস তুমি খাও কী করে?’ -আর সেই জঘন্য জিনিসটা আমার অভ্যেস হয়ে গেছে। তুমি কি সিগারেট খাওয়া ছাড়তে চেষ্টা করনি? -নাহ। তুমি থাকতে আমাকে বুঝিয়ে বলতে। একটা কথা বলেছিলে মনে আছে? -কী কথা? -একবার বললাম যে সিগারেট ছেড়ে দিব। তখন তুমি বললে, ‘তুমি যদি আমার জন্য সিগারেট ছাড়তে পারো, তাহলে আমি তোমার জন্য সিগারেটের দুর্গন্ধ সহ্য করতে পারব না কেন? একটা প্রশ্ন মনে পড়ল। তুমি এশট্রে রাখো কেন? -তোমার জন্য। উত্তর শুনে হা করে আছে রাশেদ। প্রশ্ন করল মৌরী, বিশ্বাস করলে না? -বিশ্বাস করা বা না করার চেয়ে অবাক হচ্ছি বেশি। তুমি জানতে যে আমি কোনদিন আসব? -জানতাম না। আমার বিশ্বাস ছিল, কোন একদিন তোমার সাথে দেখা হবে। তোমাকে অনুভব করার জন্য একটা পাগলামি করতাম। -কী পাগলামি? -মাঝেমধ্যে সিগারেট ধরিয়ে এশট্রেতে রাখতাম। মনে করতাম তুমি আমার সামনে বসে সিগারেট টানছ। রাশেদ কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগে পিয়ন চা নিয়ে উপস্থিত। চায়ের কাপে একসাথে চুমুক দিল দুজনেই। সাথেসাথে দুজনে হেসে উঠল। হাসার পিছনের কারণটা বেশ রোমাঞ্চকর। রাশেদ আর মৌরীর যখন সম্পর্ক ছিল, তখন দুজনে রাত জেগে ফোনে কথা বলত। হঠাৎ দুজনে একসাথে চুপ হয়ে যাওয়া, একসাথে কথা বলে ওঠা একসাথে দীর্ঘশ্বাস ছাড়া কিংবা একসাথে চুমু খাওয়া- ব্যাপারগুলো দুএকবার হলে তাকে কাকতালীয় বলে চালিয়ে দেওয়া যেত কিন্তু হামেশাই এরকম হতো। তখন রাশেদ এবং মৌরী দুজনেই একসাথে অবাক এবং আনন্দিত হতো। আজ সেরকম একটা ঘটনা ঘটল। দুজনে একসাথে চায়ের কাপে শব্দ করে চুমুক দিল। হাসি থামিয়ে রাশেদ বলল, সেই আগের মতো। খুব নমনীয় গলায় মৌরী বলল, কী? -তোমার হাসি, তোমার অভিমান, তোমার গলার স্বর, তোমার চোখ। সবকিছু; সবকিছু ঠিক আগের মতো। -আগের মতো নেই। অনেককিছু পাল্টে গেছে। এখন হয়তো রাত জেগে ফোনে কথা হয় না। কারও দীর্ঘশ্বাস শুনি না বা কারও মোটা স্বরে গল্প বা কবিতা শুনি না। কিংবা তুমিও হয়তো কারও কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত শুনতে পাও না। -আমি এখনো তোমার গান শুনি। রাত হলেই বেলকনিতে বসে তোমার কথা ভাবি। চোখ বন্ধ করে তোমার গলায় শুনি ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে বহে কীইবা মৃদু বায়’ রাশেদের কাছ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে মৌরী গুণগুণ করে গানের একাংশ গাইতে শুরু করল, পিক কিবা কুঞ্জে কুঞ্জে কুহু কুহু কুহু গায়, কী জানি কিসেরও লাগি প্রাণ করে হায়-হায়। তখন রাশেদ বলল, সেই স্বর, সেই সুর। তুমি জানো মৌরী? আমি এখনো তোমার স্পর্শ অনুভব করি। একটা দিন, মাত্র একটা দিন তোমার সাথে আমার দেখা হয়েছিল। তুমি আমার হাত ধরেছিলে। তোমার কোমল হাতের স্পর্শ আমি কখনো ভুলতে পারিনি। সেই অনুভূতি আমি এখনো পাই। কিভাবে পাই তা জানি না। কিন্তু মাঝেমধ্যে মনে হয় তুমি আমাকে ছুঁয়ে যাও। তোমার কি এমন হয় না? একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মৌরী। হয়তো হয়, হয়তো না। তুমি আমার জীবন থেকে যে সময়টা চলে গেছিলে….. -ভুল বললে। আমি যাইনি, তুমি গিয়েছিলে। -আঘাতটা তো তুমিই দিয়েছিলে। যাইহোক, ওই সময়ে ওই আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা ছিল না। আমি পাগলের মতো হয়ে যাচ্ছিলাম। আমার মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা, ডাক্তারি হওয়াটা বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থায় ছিল। -তার জন্য সরি বলে ক্ষমা আশা করছি না। আমি জানি, আমার একটা ভুল তোমার জীবনে অনেক বড় ক্ষতি করেছে। আর শুধুমাত্র একটা শব্দ ‘সরি’ সেই ভুলের মাশুল হতে পারে না। ওই ভুলের জন্য অনেক বড় মূল্য দিতে হয়। -বাদ দাও ওসব। বর্তমানের কথা বল। বিয়ে করেছ? শব্দ করে হাসল রাশেদ। কোনরকম হাসি থামিয়ে বলল, তোমার কী ধারণা আমি দেবদাসের মতো বিয়েশাদি না করে পাগল হয়ে ঘুরে বেড়াব? হ্যাঁ, এটা ঠিক যে তোমার চলে যাওয়ার পর অনেক পাগলামি করেছিলাম। শেষপর্যন্ত আশা রেখেছিলাম যে তোমার সাথে একবার হলেও যোগাযোগ করতে পারব কিন্তু যখন তোমার সাথে যোগাযোগের সব পথ বন্ধ হয়ে গেল, তখন আর উপায় ছিল না। এদিকে তখন বাড়ি থেকেও বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছিল। সবকিছু মিলিয়ে দেখলাম যে, তোমাকে আর পাওয়া হবে না। তাই বিয়েশাদি করে পুরোদস্তুর সংসারী হয়ে গেলাম। -কিন্তু তোমাকে দেখে আগের মতো সেই বোহেমিয়ান মনে হচ্ছে, সংসারী মনে হচ্ছে না। চুলটুল তো পাকিয়ে ফেলেছ। চুলে কালি কর না কেন? -তুমি তো জান, আমি যা নই তা দেখানোতে আমার তৎপরতা নেই। চুল পেকেছে, থাকুক পাকা চুল। -অবশ্য দেখতে ভালই লাগছে। চাকরিবাকরি কর কিছু? -করতাম একটা। বারো বছর পর ছেড়ে দিয়েছি। এখন ব্যবসাবাণিজ্য করছি। পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে মৌরীকে দিল রাশেদ। কার্ডটা নিয়ে মৌরী দেখল তাতে লেখা ‘মৌরী গ্রুপ অফ কোম্পানি’। কার্ডের দিকে চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে মৌরী। তারপর জিজ্ঞেস করল, আমার নামে তোমার কোম্পানি? রাশেদ হেসে বলল, না। আমার মেয়েটার নামে। আর তার নাম রেখেছিলাম তোমার নামে। -তোমার বউ এ ব্যাপারে কিছু বলে না? -প্রথম প্রথম খোঁচাতো। কিন্তু এখন আর বলে না। -সে কী করে? -সংসার করে। পুরোদস্তুর সংসারী মেয়ে সে। -আমার চেয়েও ভালো? প্রশ্নটায় এক প্রকার অনুযোগ ছিল। রাশেদ তা বুঝতে পেরে বলল, দেখ, তোমাকে তো প্রেমিকা হিসেবে পেয়েছিলাম কিন্তু তাকে পাইনি। আবার তাকে স্ত্রী হিসেবে পেয়েছি, তোমাকে পাইনি। তাই তুলনাটা করা যাচ্ছে না। তবে বললে বিশ্বাস করবে? -কী? জীবনে অনেক মেয়ের সাথে পরিচয় হয়েছে, হয়তো অনেক মেয়ের সাথে সম্পর্কেও জড়িয়েছি। কিন্তু তোমাকে ছাড়া আর কাউকে ভালবাসতে পারিনি। আর তুমি শুধু আমাকে ভালই বাসোনি, তুমি আমাকে শিখিয়েছ কিভাবে ভালবাসতে হয়। আর সেই ভালবাসাটা আমি কাউকে দিতে পারিনি মৌরী। রাশেদের গলা ধরে এসেছে। টেবিলের উপর রাখা প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরাতে চেষ্টা করছে সে, কিন্তু পারছে না। তার হাত কাঁপছে। মৌরী এসে রাশেদের সামনে টেবিলে বসে লাইটারটা নিয়ে সিগারেট ধরিয়ে দিল। সিগারেটে ঘনঘন টান দিচ্ছে রাশেদ। মৌরী রাশেদের ডান হাতটা তার দুহাতের মধ্যে নিয়ে নিল। কেউ কোন কথা বলছে না। কিন্তু দুজনের নীরবতাও অনেক কথার ঊর্ধ্বে। মৌরী আর রাশেদ চেম্বার থেকে বের হয়েছে। চেম্বারের বাইরে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে দুজন। রাশেদ বলল, তোমার হাজবেন্ড কী করে? প্রশ্নটা শুনে মৌরী অপ্রস্তুত হয়ে গেল। আমতাআমতা করে বলল, তুমি কিভাবে বুঝলে যে আমি বিয়ে করেছি? -না বোঝার কোন কারণ নেই। আর তোমার মোবাইলের স্ক্রিনে তোমার আর তোমার হাজবেন্ডের ছবি। -ওহ। ও ইঞ্জিনিয়ার। -বাহ। স্বামী ইঞ্জিনিয়ার, স্ত্রী ডাক্তার। তো, সুখেই আছো, না? বাচ্চাকাচ্চা? -একটা ছেলে। চার বছর বয়স। তখনি মৌরীর গাড়ি চলে এলো। সে জিজ্ঞেস করল রাশেদকে, তুমি কোথায় যাবে? -আমার অফিসে যাব। মিরপুরে। -তোমার গাড়ি নেই? -গাড়ি ছেড়ে দিয়েছি। সমস্যা নেই, আমি ক্যাব নিয়ে চলে যাব। -চল, তোমাকে সামনে ড্রপ করে দেই। -না, থাকুক। সারাজীবন একসাথে চলার ইচ্ছা ছিল। এখন এতটুকু পথ নাহয় নাই গেলাম। -রাখ তো তোমার নাটকীয় কথাবার্তা। গাড়িতে ওঠ। -তোমার এই ভদ্রতার জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমি গাড়িতে উঠব না। যাও, আর হ্যাঁ, ভালো থেকো। মৌরী গাড়িতে উঠে বসল। রাশেদ নির্লিপ্তভাবে হেঁটে চলছে। মৌরী ধারণা করেছিল রাশেদ একবার ফিরে তাকাবে কিন্তু রাশেদ তাকায়নি। সে তাকালে মৌরী দেখতে পেতো রাশেদের চোখদুটো ভেজা। বেশ কয়েকদিন পরের কথা। রাশেদের অফিসের কর্ম ব্যস্ততায় সময় চলে যায়। তার মধ্যেও প্রায়ই একটু সময় বের করে। সোম থেকে বুধ- এই তিনটা দিন সময় বের করে মৌরীর চেম্বারে যায়। রিসিপশনের ছেলেটা আড়চোখে দুএকবার তাকায় রাশেদের দিকে। আজ রোগীর ভিড় কম। রাশেদ বসে আছে ওয়েটিং রুমে। সে বেশ আগে এলেও তার সিরিয়াল আসছে না অর্থাৎ তাকে ডাকা হচ্ছে না। সে বাদে বাকি সবার ডাক পড়ছে। সব রোগী দেখা শেষ হলে মৌরী বেরিয়ে এল। রাশেদকে বলল, তুমি গাড়ি এনেছ? -হ্যাঁ। -চল। -কোথায়? -আমি যেখানে বলি। ড্রাইভিং সিটে রাশেদ, পাশের সিটে মৌরী। ঢাকা শহরের যানজট পার করে তারা চলে এসেছে কেরানীগঞ্জ পার হয়ে আরও সামনে। অনেক প্রশস্ত রাস্তার পাশে ছোটছোট ক্যাফেটেরিয়া। রাস্তার দুপাশে কাশবন। এখনো কাশফুল ফোটেনি। সবুজের সাগর মনে হচ্ছে। এই সবুজের মধ্যে মৌরীর মুখে জমে আছে কালো মেঘ। রাশেদ পকেট থেকে প্যাকেট বের করে সিগারেট ধরাল। একটা ক্যাফেটেরিয়ার সামনে দুজনে বসেছে। মৌরী সময় নিচ্ছে কথাগুলো গুছিয়ে নেওয়ার জন্য। রাশেদ বুঝতে পারছে কোন কারণে মৌরী তার উপর রাগ বা বিরক্ত। কিন্তু কারণটা সে বুঝতে পারছে না। ওয়েটার দুই মগ কফি দিয়ে গেছে। ধোঁয়া উড়ছে সেখান থেকে। কফির ঘ্রাণটাও নাকে আসছে, বেশ মিষ্টি ঘ্রাণ। সিগারেট শেষ হতে মৌরী বলল, আরেকটা সিগারেট ধরাও। সিগারেটের ধোঁয়া একটা আড়াল তৈরি করবে। তোমার সাথে যে কথাগুলো বলব তা আমি তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে পারব না৷ আবার অন্যদিকে তাকিয়েও বলতে পারব না। তোমার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে হবে। রাশেদ ফের সিগারেট ধরাল। মৌরী কথাগুলো গুছিয়ে বলতে পারেনি। বাকি কথাগুলো যদি এলোমেলো করে বলে তাহলে সমস্যা হতে পারে। তবুও সে শুরু করল, দেখ রাশেদ, তোমার সম্পর্কটা শেষ হয়েছে একুশ বছর আগে। তার আগে মাত্র একটা বছর সম্পর্ক ছিল এবং সেই এক বছরে মাত্র একটা দিনের একটা ঘণ্টা আমরা একসাথে ছিলাম। তাও যে নির্জন স্থানে বা বদ্ধ রুমে ছিলাম তা কিন্তু না। ভিড়ের মধ্যে দুজনে হাত ধরে হেঁটেছিলাম। সেই অনুভূতি, সেই স্মৃতি আমি বেশকিছু দিন বয়ে বেড়ালেও সময় এবং পরিস্থিতি আমাকে তা ভুলতে সাহায্য করেছে। এই একুশ বছরে প্রথম দিকে দু-চারবার মনে পড়লেও আমি তোমাকে সেরকম মনে করিনি বা তোমার কথা খুব একটা মনে পড়েনি। তোমাকে ভুলে আমার লাভই হয়েছে। আমার ডাক্তারি পড়া শেষ হয়েছে, আমি ডাক্তার হয়েছি, আমার ফ্যামিলির দায়িত্ব নিয়েছি, বিয়ে করে সংসার করছি। আমি কিন্তু খারাপ নেই। কিন্তু…. একটু দম নেওয়ার জন্য থামল মৌরী। রাশেদ নিথর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মৌরীর ঠোঁটের দিকে। কত সুন্দর করেই না সে কথা বলছে। দম নিয়ে মৌরী বলল, কিন্তু তুমি এতদিন পরে সামনে এসে আমার সুন্দর গোছানো জীবনটা এলোমেলো করে দিয়েছ। আমি তো এমনটা চাইনি। তুমি যেদিন প্রথম এসেছিলে, তখন প্রথমেই তোমার সাথে যেরকম আচরণটা করেছিলাম, ওইটা ধরে রাখলে এতকিছু হতো না৷ তোমার সাথে একটু ভালো করে কথা বললাম, আর তুমি সুযোগটা নিয়ে নিলে। অবশ্য আমারও পুরনো দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু রাশেদ, তোমার সংসার আছে, স্ত্রী আছে, সন্তান আছে। আমারও স্বামী-সন্তান, সুন্দর একটা সংসার হয়েছে। কেন আমরা এগুলোকে নষ্ট করছি? চুপ করে থেকো না, কথা বল। রাশেদ নমনীয় গলায় বলল, বলতে থাকো। আবারও দম নিয়ে বলা শুরু করল মৌরী, তুমি যা করছ তা একটা টিনেজার ছেলেকে মানায়, একটা মধ্যবয়সী আধবুড়োকে মানায় না। আর তুমি তো ব্যক্তিত্বহীন নও, আমি তোমাকে ভালবেসেছিলাম তোমার ব্যক্তিত্বকে, তোমার ইগোকে। সেই তুমি ব্যক্তিত্বহীনের মতো আমার পিছু নাও। আমার গাড়ি ফলো করে আমার বাসা পর্যন্ত গিয়েছ। একদিন দুইদিন হলে একটা কথা ছিল। কিন্তু তুমি প্রায় প্রতিটা দিনই এই কাজ করছ। লোকে এসব দেখে, রাশেদ। আর তারা এসব ভাল চোখে দেখে না। আর আমার হাজবেন্ড সেও এটা লক্ষ্য করেছে এবং তার কাছে এই খবরটা গেছে যে তার স্ত্রীর অনেক পুরনো বন্ধু বা হয়তো প্রেমিক তার সাথে দেখা করতে চেম্বারে আসে। সেও যথেষ্ট ব্যক্তিত্ববান বলে আমাকে সরাসরি এই কথাগুলো বলেনি কিন্তু তার আচরণ, কথা বলার ভঙ্গি দেখে এটুকু বুঝতে পেরেছি যে ব্যাপারটা তার ভালো লাগছে না। সে আমাকে অনেক ভালবাসে এবং আমার খেয়াল রাখে। আমি চাই না, তার সেই ভালবাসাটা কমে যাক। আর আমাদের মধ্যে একটু দূরত্ব তৈরি হলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমাদের ছেলেটা। আর একজন মা হয়ে সন্তানের এমন ক্ষতি চাইব না। তাই তোমার কাছে অনুরোধ, তুমি প্লিজ আমার কাছে এসো না, আমাকে ফলো কর না। তোমারও তো স্ত্রী আছে, একটা মেয়ে আছে। তাদের কথা ভাবো, তুমি তো তোমার স্ত্রীকে ঠকাচ্ছ, তাই নয় কী? -হয়তো। -হয়তো আবার কী? তোমার স্ত্রীর কথা বাদ দিলাম, তোমার মেয়েটার কথা তো ভাবো। যদি তুমি এরকম উল্টাপাল্টা কর, তাহলে তোমার সংসারে সমস্যা হবে, আর তার ফলটা ভোগ করবে তোমার নিষ্পাপ মেয়েটা। তুমি নিশ্চয় তা চাও না, এই বুড়ো বয়সে কেলেঙ্কারি হোক। থামল মৌরী। শুধুমাত্র বাতাসের শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। রাস্তা দিয়ে শোঁ শোঁ শব্দ করে দু’একটা গাড়ি ছুটে চলছে। মৌরী দেখল রাশেদ যে দ্বিতীয় সিগারেটটা ধরিয়েছিল ওটা হাতেই শেষ হয়েছে। ছাইটা এখনো পড়ে যায়নি তবে যেকোনো মুহূর্তে পড়ে যাবে। মৌরী বলল, একটা কথা বল তো, তুমি এখনো আমাকে আমাকে ভালবাসো? রাশেদ বলল, হ্যাঁ। কিন্তু তার গলার স্বরটা পাল্টে গেছে। কেমনযেন ধরে আসছে গলাটা। মৌরী বলল, কতটুকু ভালবাসো? আগের মতো? -হ্যাঁ। -যাকে ভালবাসো, তার ক্ষতি চাও তুমি? -না। -যাকে তুমি ভালবাসো, তার কথাটা শুনবে না? -হুম। -তাহলে প্লিজ, এসব বাদ দাও। কী হবে রাশেদ? এসব করে কী হবে? আমার জীবনে তোমার ফিরে আসার চান্স নেই, এবং সত্যি বলতে দরকারও নেই। আর আমি মনে করি, তোমার জীবনেও আমার দরকার নেই। প্রায় নিঃশব্দে রাশেদ বলল, দরকার আছে। কিন্তু মৌরী সেই কথাটা শুনতে পাইনি। রাশেদ বলল, দেখো মৌরী, তোমাকে আমি এক ঘণ্টার জন্য, এক দিনের জন্য বা এক বছরের জন্য ভালবাসিনি। তোমাকে ভালবেসেছি সারা জীবনের জন্য। তাই এখনো বাসি। ভবিষ্যতেও বাসব। কিন্তু তোমাকে পাবো না-এটা জানি। তবুও ভালবেসে যাব। আমার জন্য তোমার যা ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করতে পারব না। কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি, তোমাকে আর কখনো কোনদিন বিরক্ত করব না। একটু প্রশ্ন করি, উত্তর দিবে? মৌরী বলল, হ্যাঁ। বল। রাশেদ মৌরীর চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, তুমি কি এখনো আমাকে ভালবাস না? মৌরী উত্তর দিচ্ছে না। সেও তাকিয়ে আছে রাশেদের চোখের দিকে। চোখের পাতা কাঁপছে তার। ঠোঁটদুটোতে ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। উত্তরটা দিতে পারছে না। ভাইভা বোর্ডে যখন কোন চাকরি প্রার্থী প্রশ্নকর্তার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না, তখন তার যেমন অবস্থা হয়, মৌরীরও একই অবস্থা। হঠাৎ রাশেদের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে মৌরী আস্তে করে বলল, নাহ। বাসি না। রাশেদ হাসছে। নিঃশব্দে হাসি। মৌরী রাশেদের চোখের দিকে তাকাতে পারছে না। তার ব্যাগটা নিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, এখন ওঠা যাক। রাশেদ একটা গানের একটা লাইন গাইল, আরও কিছুক্ষণ কি রবে বন্ধু? আরও কিছু কথা কি হবে? গানের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসল। রাশেদও গাড়িতে উঠে পড়ল। এই ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইল দু’মগ কফি। রাশেদ গাড়িতে উঠে রেডিও ছাড়ল। কী কাকতালীয় ব্যাপার! রাশেদের সবচেয়ে প্রিয় গানটাই বাজছে, O light the candle, John The daylight has almost gone The birds have sung their last The bells call all to mass. সারাটা পথ দুজনের কেউ কোন কথা বলল না। এমনকি মৌরী গাড়ি থেকে নামার সময় মৌরী বা রাশেদ কেউই বলেনি ‘ভালো থেকো’। মাসখানেক পরের কথা। সেদিনের পর থেকে রাশেদ কখনো মৌরীর চেম্বারে আসেনি। বরং রাশেদ না আসাতে মৌরীর খারাপ লেগেছে। তবে ধীরেধীরে সে রাশেদের ব্যাপারটা মাথা থেকে বাদ দিতে সক্ষম হয়েছে। ঠিক তখনি এক রোগী এলো মৌরীর কাছে। রোগীকে দেখা শেষ হওয়ার পর সাধারণত উঠে চলে যায়। কিন্তু এই রোগী চলে না গিয়ে বসে রইল। তারপর বলল, আমি সম্ভবত আপনাকে চিনি। মৌরী অবাক হয়ে বলল, চেনেন মানে? আমাকে আগে কোথাও দেখেছেন? যেহেতু ডাক্তারি করি, হাসপাতালে চাকরি করি, দেখে থাকতে পারেন। -না। হাসপাতালে না। আপনাকে দেখেছি একজনের অতীতে। তার গল্পে, তার স্মৃতিতে। সেখানে আপনি ডাক্তার না, একজন প্রেমিকা। -কী বলতে চাচ্ছেন? -আমি যদি ভুল না করি, আপনি মৌরী। রাশেদ নামে কাউকে চেনেন বা চিনতেন? মৌরী যা এতদিন ধরে ভোলার চেষ্টা করছে, এই লোকটা তা মনে করিয়ে দিচ্ছে৷ মৌরী বলল, হ্যাঁ। চিনি। -রাশেদ আপনার কথা এতই বলে যে মাঝেমধ্যে রাগ হত, বিরক্ত হয়ে যেতাম। এক পর্যায়ে ভাবলাম, যদি কোনদিন মৌরীর দেখা পায় একটা কথা বলব। -কী কথা? -আপনি একটা কোহিনূর হীরা হারিয়েছেন। কেউ যে একটা মেয়েকে বিশ-একুশ বছর ধরে কিভাবে ভালবেসে যায়। যার জন্য বিয়েটা পর্যন্ত করেনি। অনেক টাকাপয়সা পয়সা জমিয়েছে। কিন্তু ওসব কে খাবে? ওকে কত বোঝালাম যে, বিয়েটা করে সংসারী হ। কিন্তু কে শোনে কার কথা? করলই না। মৌরীর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। সে ড্রয়ার থেকে রাশেদের দেওয়া কার্ডটা বের করতে করতে বলল, ও তো বলেছে ও বিয়ে করেছে। কার্ডটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ওর মেয়ের নামে কোম্পানি দিয়েছে। লোকটা হেসে বলল, কোম্পানিটা ওর মেয়ের নামে না, আপনার নামে। আর ও মেয়ে পাবে কোথায়? বিয়েই তো করেনি। আপনার সাথে ওর দেখা হয়েছিল? -হ্যাঁ। কিছুদিন আগে হঠাৎ আমার চেম্বারে এসেছিল। বেশকিছু দিন দেখা হল। পরে ওকে বুঝিয়ে বললাম যে দেখা করাটা আমার জন্য ক্ষতিকর হয়ে যাচ্ছে। তখন ও বলেছিল যে বিয়ে করেছে। একটা মেয়ে আছে। আমার নামেই মেয়েটার নাম রেখেছে। -আপনাকে মিথ্যা বলেছে সে। আমি গত দুই মাস ব্যবসায়ের কাজে সিঙ্গাপুর গেছিলাম। ও হ্যাঁ, আমার পরিচয়টাই তো দেওয়া হয়নি। আমি সুলতান মাহমুদ। মৌরী আবার চমকালো। ওদের সম্পর্কের সময় রাশেদের মুখে একটা ছেলের নাম বেশি শুনত। আর সে হচ্ছে ‘সুলতান মাহমুদ’। মৌরী বলল, আপনার কথা ওর মুখে অনেক শুনতাম। -আর আমরা এখন একসাথে ব্যবসা করি। যাইহোক, ভালো লাগল আপনাকে দেখে। ভালো থাকবেন। আমার একটা মিটিংয়ে জয়েন করা লাগবে। তাই উঠছি। সুলতান মাহমুদ চলে গেল। মৌরী জানালার দিকে তাকিয়ে আছে নিশ্চুপ হয়ে। এতটাও ভালবাসা যায়? সিনেমায় দেখেছে এরকম। আর তাকেই কেউ সেই সিনেমার নায়কের মতো ভালবাসে? কিছুক্ষণ পর রাশেদের ডাক এলো। রাশেদ উঠে গিয়ে ডাক্তারের চেম্বারের দিকে গেল। এয়ার কন্ডিশনড রুম। একজন দরজা খুলে দিল। রাশেদ দরজার কাছ থেকেই জিজ্ঞেস করল, ভিতরে আসব? রোগীরা সাধারণত এই ভদ্রতাটুকু দেখায় না। তারা থাকে রোগে শোকে কাতর। ভদ্রতা দেখানোর সময় নেই। ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকেই বলে, ডাক্তার, আমার কী হয়েছে, তাড়াতাড়ি বলেন। রাশেদের প্রশ্ন শুনে ডা. মারজিয়া মৌরী না তাকিয়ে বলল, আসুন। টেবিলের কাছাকাছি আসতেই বলল, বসুন। রাশেদ বসল না। সে তাকিয়ে আছে মৌরীর দিকে। আগের থেকে সামান্য মোটা হয়েছে। গায়ের রঙ কিছুটা উজ্জ্বল হয়েছে। আর চোখে উঠেছে মোটা ফ্রেমের চশমা। মৌরী বলল, কী ব্যাপার দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ব….. কথাটা শেষ করার আগে তাকালো রাশেদের দিকে। মাথায় কাঁচাপাকা চুল। পুরুষ্টু গোঁফ, মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি। কিন্তু চেহারাটা আগের মতো না থাকলেও চিনতে কষ্ট হয়নি। আচ্ছা, ওর কণ্ঠটা কি আগের মতোই আছে? বসতে বসতে রাশেদ জিজ্ঞেস করল, কেমন আছো মৌরী? মৌরী উত্তর দিল না। আগের মতোই মোটা কণ্ঠ। কী সুন্দর স্পষ্ট উচ্চারণ! মৌরী চোখমুখ থেকে বিস্ময় ভাব দূর করে বলল, ভালো। পরক্ষণেই সে বলল, কী সমস্যা আপনার বলুন। বলেই প্রেসক্রিপশনের প্যাড আর কলম নিয়ে রেডি হল ওষুধ লেখার জন্য। রাশেদ হেসে বলল, রাখো তো ওসব। -দেখুন, আপনার সাথে বসে গল্প করার সময় নেই আমার। বাইরে আরও পেশেন্ট বসে আছে। তাদের দেখতে হবে। -সাধারণত মেডিসিন স্পেশালিস্টের কাছে ইমার্জেন্সি পেশেন্ট আসে না। আজকের জন্য নাহয় এই পেশেন্টটাকেই দেখ। -আপনার ন্যাকামি বন্ধ করুন এবং আপনি চলে যান। -প্রায় বিশ বছর পরে দেখা। কিছু কথা না বলে কিভাবে যায়? -আপনি কি যাবেন নাকি আমি দারোয়ান ডেকে বের করে দিব? -বাংলা সিনেমা বেশি বেশি দেখছ নাকি? যাও, ডেকে নিয়ে এসো। তোমার দারোয়ান দেখুক যে তোমার বিশ বছর পুরনো প্রাক্তন প্রেমিক তোমার চেম্বারে বসে আছে। বলেই পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালো রাশেদ। মৌরী দ্রুত গতিতে বের হয়ে গেল চেম্বার থেকে। তার ডাক্তারি পেশার এই দীর্ঘ সময়ে এতটা অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়েনি কখনো। প্রায় দুই মিনিট পর ফিরে এলো সে। ড্রয়ার থেকে একটা সুদর্শন এশট্রে বের করে দিয়ে বলল, এটাতে ছাই ফেলুন। বলেই মৌরী ওয়াশরুমে ঢুকল। ট্যাপ ছাড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। সিগারেট টানতে থাকল রাশেদ। ঠোঁটের কোণে অস্ফুট হাসি। মুখে পানি দিয়েছে মৌরী। মুখ মুছতে মুছতে বলল সে, এতদিন পর কী মনে করে? -মনে তো করি সবসময়। কিন্তু খুঁজে পাইনি কখনো। -আপনি কি এখনো হেঁয়ালি করে কথা বলেন? -না। শুধু তোমার সাথে বলছি। তাই হেঁয়ালিপনাটা পরিপক্ক হচ্ছে না। -তাহলে দয়া করে হেঁয়ালি করা বন্ধ করুন। -বন্ধ করছি। তার আগে দয়া করে তুমি ‘আপনি আপনি’ করে কথা বলাটা বন্ধ কর। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মৌরী। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে পড়ল সে। ইজিচেয়ারটায় দোল খেতে খেতে তাকিয়ে আছে রাশেদের দিকে। চুলদাড়ি পাকা হলেও চেহারার মধ্যে আগের সেই কোমলতা আছে। আগে ঠোঁট ছিল লাল আর এখন হয়েছে কালো। সিগারেটটা কি খুব বেশি খায়? সিগারেট শেষ করে রাশেদ বলল, ভাবতেই পারিনি তোমাকে সত্যিই আবার পেয়ে যাব। -খুঁজেছ কখনো? -হয়তো পাগল প্রেমিকের মতো তোমার বাড়ির সামনে বা কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকিনি। কিন্তু তোমার পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের তো জ্বালিয়েছি তোমার কথা জিজ্ঞেস করে। -তাতে আমার ক্ষতিই হয়েছে। যে বা যারা আমাকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কিছু বলার সাহস পেতো না, তারাও আমার দিকে আঙ্গুল তুলে কথা বলেছে শুধুমাত্র তোমার জন্য। তুমি আমার মায়ের কাছেও ফোন করেছিলে। উল্টাপাল্টা কথা বলেছিলে। -উল্টাপাল্টা বলিনি। তিনি যা জিজ্ঞেস করেছেন তার উত্তর দিয়েছিলাম। -তার উত্তর ভদ্রভাবেও দেওয়া যায়। -মেকি ভদ্রতা দেখানো আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আর তোমাকে হারানোর পর আমি প্রায় পাগল হয়ে গেছিলাম। -কিন্তু তোমার পাগলামিতে একটা মেয়ের ক্ষতি হতে পারে, সেটা কি ভাবোনি? -আমি তোমার কোন ক্ষতি করিনি। -যাক, ও তর্কে যেতে চাই না। চা খাবে? -হুম। খাওয়া যেতে পারে। তোমার পেশেন্টরা কোথায়? -বিদায় করে দিয়েছি। কারণ তুমি আগে যেমন পাগল ছিলে, এখনো সেরকমই আছ। রাশেদ হাসল। বেল টিপে পিয়নকে ডেকে বলল, দুইটা চিনি ছাড়া চা দাও। রাশেদ চোখ বড় করে তাকাল মৌরীর দিকে। জিজ্ঞেস করল, তুমি চিনি ছাড়া চা খাওয়া ধরলে কবে? -তোমার সাথে রিলেশন থাকাকালীন সময়ে মাঝেমধ্যে খেতাম তা তো জানই। -হ্যাঁ। তুমি কত সুন্দর করেই না বলতে ‘এই জঘন্য জিনিস তুমি খাও কী করে?’ -আর সেই জঘন্য জিনিসটা আমার অভ্যেস হয়ে গেছে। তুমি কি সিগারেট খাওয়া ছাড়তে চেষ্টা করনি? -নাহ। তুমি থাকতে আমাকে বুঝিয়ে বলতে। একটা কথা বলেছিলে মনে আছে? -কী কথা? -একবার বললাম যে সিগারেট ছেড়ে দিব। তখন তুমি বললে, ‘তুমি যদি আমার জন্য সিগারেট ছাড়তে পারো, তাহলে আমি তোমার জন্য সিগারেটের দুর্গন্ধ সহ্য করতে পারব না কেন? একটা প্রশ্ন মনে পড়ল। তুমি এশট্রে রাখো কেন? -তোমার জন্য। উত্তর শুনে হা করে আছে রাশেদ। প্রশ্ন করল মৌরী, বিশ্বাস করলে না? -বিশ্বাস করা বা না করার চেয়ে অবাক হচ্ছি বেশি। তুমি জানতে যে আমি কোনদিন আসব? -জানতাম না। আমার বিশ্বাস ছিল, কোন একদিন তোমার সাথে দেখা হবে। তোমাকে অনুভব করার জন্য একটা পাগলামি করতাম। -কী পাগলামি? -মাঝেমধ্যে সিগারেট ধরিয়ে এশট্রেতে রাখতাম। মনে করতাম তুমি আমার সামনে বসে সিগারেট টানছ। রাশেদ কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগে পিয়ন চা নিয়ে উপস্থিত। চায়ের কাপে একসাথে চুমুক দিল দুজনেই। সাথেসাথে দুজনে হেসে উঠল। হাসার পিছনের কারণটা বেশ রোমাঞ্চকর। রাশেদ আর মৌরীর যখন সম্পর্ক ছিল, তখন দুজনে রাত জেগে ফোনে কথা বলত। হঠাৎ দুজনে একসাথে চুপ হয়ে যাওয়া, একসাথে কথা বলে ওঠা একসাথে দীর্ঘশ্বাস ছাড়া কিংবা একসাথে চুমু খাওয়া- ব্যাপারগুলো দুএকবার হলে তাকে কাকতালীয় বলে চালিয়ে দেওয়া যেত কিন্তু হামেশাই এরকম হতো। তখন রাশেদ এবং মৌরী দুজনেই একসাথে অবাক এবং আনন্দিত হতো। আজ সেরকম একটা ঘটনা ঘটল। দুজনে একসাথে চায়ের কাপে শব্দ করে চুমুক দিল। হাসি থামিয়ে রাশেদ বলল, সেই আগের মতো। খুব নমনীয় গলায় মৌরী বলল, কী? -তোমার হাসি, তোমার অভিমান, তোমার গলার স্বর, তোমার চোখ। সবকিছু; সবকিছু ঠিক আগের মতো। -আগের মতো নেই। অনেককিছু পাল্টে গেছে। এখন হয়তো রাত জেগে ফোনে কথা হয় না। কারও দীর্ঘশ্বাস শুনি না বা কারও মোটা স্বরে গল্প বা কবিতা শুনি না। কিংবা তুমিও হয়তো কারও কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত শুনতে পাও না। -আমি এখনো তোমার গান শুনি। রাত হলেই বেলকনিতে বসে তোমার কথা ভাবি। চোখ বন্ধ করে তোমার গলায় শুনি ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে বহে কীইবা মৃদু বায়’ রাশেদের কাছ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে মৌরী গুণগুণ করে গানের একাংশ গাইতে শুরু করল, পিক কিবা কুঞ্জে কুঞ্জে কুহু কুহু কুহু গায়, কী জানি কিসেরও লাগি প্রাণ করে হায়-হায়। তখন রাশেদ বলল, সেই স্বর, সেই সুর। তুমি জানো মৌরী? আমি এখনো তোমার স্পর্শ অনুভব করি। একটা দিন, মাত্র একটা দিন তোমার সাথে আমার দেখা হয়েছিল। তুমি আমার হাত ধরেছিলে। তোমার কোমল হাতের স্পর্শ আমি কখনো ভুলতে পারিনি। সেই অনুভূতি আমি এখনো পাই। কিভাবে পাই তা জানি না। কিন্তু মাঝেমধ্যে মনে হয় তুমি আমাকে ছুঁয়ে যাও। তোমার কি এমন হয় না? একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মৌরী। হয়তো হয়, হয়তো না। তুমি আমার জীবন থেকে যে সময়টা চলে গেছিলে….. -ভুল বললে। আমি যাইনি, তুমি গিয়েছিলে। -আঘাতটা তো তুমিই দিয়েছিলে। যাইহোক, ওই সময়ে ওই আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা ছিল না। আমি পাগলের মতো হয়ে যাচ্ছিলাম। আমার মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা, ডাক্তারি হওয়াটা বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থায় ছিল। -তার জন্য সরি বলে ক্ষমা আশা করছি না। আমি জানি, আমার একটা ভুল তোমার জীবনে অনেক বড় ক্ষতি করেছে। আর শুধুমাত্র একটা শব্দ ‘সরি’ সেই ভুলের মাশুল হতে পারে না। ওই ভুলের জন্য অনেক বড় মূল্য দিতে হয়। -বাদ দাও ওসব। বর্তমানের কথা বল। বিয়ে করেছ? শব্দ করে হাসল রাশেদ। কোনরকম হাসি থামিয়ে বলল, তোমার কী ধারণা আমি দেবদাসের মতো বিয়েশাদি না করে পাগল হয়ে ঘুরে বেড়াব? হ্যাঁ, এটা ঠিক যে তোমার চলে যাওয়ার পর অনেক পাগলামি করেছিলাম। শেষপর্যন্ত আশা রেখেছিলাম যে তোমার সাথে একবার হলেও যোগাযোগ করতে পারব কিন্তু যখন তোমার সাথে যোগাযোগের সব পথ বন্ধ হয়ে গেল, তখন আর উপায় ছিল না। এদিকে তখন বাড়ি থেকেও বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছিল। সবকিছু মিলিয়ে দেখলাম যে, তোমাকে আর পাওয়া হবে না। তাই বিয়েশাদি করে পুরোদস্তুর সংসারী হয়ে গেলাম। -কিন্তু তোমাকে দেখে আগের মতো সেই বোহেমিয়ান মনে হচ্ছে, সংসারী মনে হচ্ছে না। চুলটুল তো পাকিয়ে ফেলেছ। চুলে কালি কর না কেন? -তুমি তো জান, আমি যা নই তা দেখানোতে আমার তৎপরতা নেই। চুল পেকেছে, থাকুক পাকা চুল। -অবশ্য দেখতে ভালই লাগছে। চাকরিবাকরি কর কিছু? -করতাম একটা। বারো বছর পর ছেড়ে দিয়েছি। এখন ব্যবসাবাণিজ্য করছি। পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে মৌরীকে দিল রাশেদ। কার্ডটা নিয়ে মৌরী দেখল তাতে লেখা ‘মৌরী গ্রুপ অফ কোম্পানি’। কার্ডের দিকে চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে মৌরী। তারপর জিজ্ঞেস করল, আমার নামে তোমার কোম্পানি? রাশেদ হেসে বলল, না। আমার মেয়েটার নামে। আর তার নাম রেখেছিলাম তোমার নামে। -তোমার বউ এ ব্যাপারে কিছু বলে না? -প্রথম প্রথম খোঁচাতো। কিন্তু এখন আর বলে না। -সে কী করে? -সংসার করে। পুরোদস্তুর সংসারী মেয়ে সে। -আমার চেয়েও ভালো? প্রশ্নটায় এক প্রকার অনুযোগ ছিল। রাশেদ তা বুঝতে পেরে বলল, দেখ, তোমাকে তো প্রেমিকা হিসেবে পেয়েছিলাম কিন্তু তাকে পাইনি। আবার তাকে স্ত্রী হিসেবে পেয়েছি, তোমাকে পাইনি। তাই তুলনাটা করা যাচ্ছে না। তবে বললে বিশ্বাস করবে? -কী? জীবনে অনেক মেয়ের সাথে পরিচয় হয়েছে, হয়তো অনেক মেয়ের সাথে সম্পর্কেও জড়িয়েছি। কিন্তু তোমাকে ছাড়া আর কাউকে ভালবাসতে পারিনি। আর তুমি শুধু আমাকে ভালই বাসোনি, তুমি আমাকে শিখিয়েছ কিভাবে ভালবাসতে হয়। আর সেই ভালবাসাটা আমি কাউকে দিতে পারিনি মৌরী। রাশেদের গলা ধরে এসেছে। টেবিলের উপর রাখা প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরাতে চেষ্টা করছে সে, কিন্তু পারছে না। তার হাত কাঁপছে। মৌরী এসে রাশেদের সামনে টেবিলে বসে লাইটারটা নিয়ে সিগারেট ধরিয়ে দিল। সিগারেটে ঘনঘন টান দিচ্ছে রাশেদ। মৌরী রাশেদের ডান হাতটা তার দুহাতের মধ্যে নিয়ে নিল। কেউ কোন কথা বলছে না। কিন্তু দুজনের নীরবতাও অনেক কথার ঊর্ধ্বে। মৌরী আর রাশেদ চেম্বার থেকে বের হয়েছে। চেম্বারের বাইরে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে দুজন। রাশেদ বলল, তোমার হাজবেন্ড কী করে? প্রশ্নটা শুনে মৌরী অপ্রস্তুত হয়ে গেল। আমতাআমতা করে বলল, তুমি কিভাবে বুঝলে যে আমি বিয়ে করেছি? -না বোঝার কোন কারণ নেই। আর তোমার মোবাইলের স্ক্রিনে তোমার আর তোমার হাজবেন্ডের ছবি। -ওহ। ও ইঞ্জিনিয়ার। -বাহ। স্বামী ইঞ্জিনিয়ার, স্ত্রী ডাক্তার। তো, সুখেই আছো, না? বাচ্চাকাচ্চা? -একটা ছেলে। চার বছর বয়স। তখনি মৌরীর গাড়ি চলে এলো। সে জিজ্ঞেস করল রাশেদকে, তুমি কোথায় যাবে? -আমার অফিসে যাব। মিরপুরে। -তোমার গাড়ি নেই? -গাড়ি ছেড়ে দিয়েছি। সমস্যা নেই, আমি ক্যাব নিয়ে চলে যাব। -চল, তোমাকে সামনে ড্রপ করে দেই। -না, থাকুক। সারাজীবন একসাথে চলার ইচ্ছা ছিল। এখন এতটুকু পথ নাহয় নাই গেলাম। -রাখ তো তোমার নাটকীয় কথাবার্তা। গাড়িতে ওঠ। -তোমার এই ভদ্রতার জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমি গাড়িতে উঠব না। যাও, আর হ্যাঁ, ভালো থেকো। মৌরী গাড়িতে উঠে বসল। রাশেদ নির্লিপ্তভাবে হেঁটে চলছে। মৌরী ধারণা করেছিল রাশেদ একবার ফিরে তাকাবে কিন্তু রাশেদ তাকায়নি। সে তাকালে মৌরী দেখতে পেতো রাশেদের চোখদুটো ভেজা। বেশ কয়েকদিন পরের কথা। রাশেদের অফিসের কর্ম ব্যস্ততায় সময় চলে যায়। তার মধ্যেও প্রায়ই একটু সময় বের করে। সোম থেকে বুধ- এই তিনটা দিন সময় বের করে মৌরীর চেম্বারে যায়। রিসিপশনের ছেলেটা আড়চোখে দুএকবার তাকায় রাশেদের দিকে। আজ রোগীর ভিড় কম। রাশেদ বসে আছে ওয়েটিং রুমে। সে বেশ আগে এলেও তার সিরিয়াল আসছে না অর্থাৎ তাকে ডাকা হচ্ছে না। সে বাদে বাকি সবার ডাক পড়ছে। সব রোগী দেখা শেষ হলে মৌরী বেরিয়ে এল। রাশেদকে বলল, তুমি গাড়ি এনেছ? -হ্যাঁ। -চল। -কোথায়? -আমি যেখানে বলি। ড্রাইভিং সিটে রাশেদ, পাশের সিটে মৌরী। ঢাকা শহরের যানজট পার করে তারা চলে এসেছে কেরানীগঞ্জ পার হয়ে আরও সামনে। অনেক প্রশস্ত রাস্তার পাশে ছোটছোট ক্যাফেটেরিয়া। রাস্তার দুপাশে কাশবন। এখনো কাশফুল ফোটেনি। সবুজের সাগর মনে হচ্ছে। এই সবুজের মধ্যে মৌরীর মুখে জমে আছে কালো মেঘ। রাশেদ পকেট থেকে প্যাকেট বের করে সিগারেট ধরাল। একটা ক্যাফেটেরিয়ার সামনে দুজনে বসেছে। মৌরী সময় নিচ্ছে কথাগুলো গুছিয়ে নেওয়ার জন্য। রাশেদ বুঝতে পারছে কোন কারণে মৌরী তার উপর রাগ বা বিরক্ত। কিন্তু কারণটা সে বুঝতে পারছে না। ওয়েটার দুই মগ কফি দিয়ে গেছে। ধোঁয়া উড়ছে সেখান থেকে। কফির ঘ্রাণটাও নাকে আসছে, বেশ মিষ্টি ঘ্রাণ। সিগারেট শেষ হতে মৌরী বলল, আরেকটা সিগারেট ধরাও। সিগারেটের ধোঁয়া একটা আড়াল তৈরি করবে। তোমার সাথে যে কথাগুলো বলব তা আমি তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে পারব না৷ আবার অন্যদিকে তাকিয়েও বলতে পারব না। তোমার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে হবে। রাশেদ ফের সিগারেট ধরাল। মৌরী কথাগুলো গুছিয়ে বলতে পারেনি। বাকি কথাগুলো যদি এলোমেলো করে বলে তাহলে সমস্যা হতে পারে। তবুও সে শুরু করল, দেখ রাশেদ, তোমার সম্পর্কটা শেষ হয়েছে একুশ বছর আগে। তার আগে মাত্র একটা বছর সম্পর্ক ছিল এবং সেই এক বছরে মাত্র একটা দিনের একটা ঘণ্টা আমরা একসাথে ছিলাম। তাও যে নির্জন স্থানে বা বদ্ধ রুমে ছিলাম তা কিন্তু না। ভিড়ের মধ্যে দুজনে হাত ধরে হেঁটেছিলাম। সেই অনুভূতি, সেই স্মৃতি আমি বেশকিছু দিন বয়ে বেড়ালেও সময় এবং পরিস্থিতি আমাকে তা ভুলতে সাহায্য করেছে। এই একুশ বছরে প্রথম দিকে দু-চারবার মনে পড়লেও আমি তোমাকে সেরকম মনে করিনি বা তোমার কথা খুব একটা মনে পড়েনি। তোমাকে ভুলে আমার লাভই হয়েছে। আমার ডাক্তারি পড়া শেষ হয়েছে, আমি ডাক্তার হয়েছি, আমার ফ্যামিলির দায়িত্ব নিয়েছি, বিয়ে করে সংসার করছি। আমি কিন্তু খারাপ নেই। কিন্তু…. একটু দম নেওয়ার জন্য থামল মৌরী। রাশেদ নিথর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মৌরীর ঠোঁটের দিকে। কত সুন্দর করেই না সে কথা বলছে। দম নিয়ে মৌরী বলল, কিন্তু তুমি এতদিন পরে সামনে এসে আমার সুন্দর গোছানো জীবনটা এলোমেলো করে দিয়েছ। আমি তো এমনটা চাইনি। তুমি যেদিন প্রথম এসেছিলে, তখন প্রথমেই তোমার সাথে যেরকম আচরণটা করেছিলাম, ওইটা ধরে রাখলে এতকিছু হতো না৷ তোমার সাথে একটু ভালো করে কথা বললাম, আর তুমি সুযোগটা নিয়ে নিলে। অবশ্য আমারও পুরনো দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু রাশেদ, তোমার সংসার আছে, স্ত্রী আছে, সন্তান আছে। আমারও স্বামী-সন্তান, সুন্দর একটা সংসার হয়েছে। কেন আমরা এগুলোকে নষ্ট করছি? চুপ করে থেকো না, কথা বল। রাশেদ নমনীয় গলায় বলল, বলতে থাকো। আবারও দম নিয়ে বলা শুরু করল মৌরী, তুমি যা করছ তা একটা টিনেজার ছেলেকে মানায়, একটা মধ্যবয়সী আধবুড়োকে মানায় না। আর তুমি তো ব্যক্তিত্বহীন নও, আমি তোমাকে ভালবেসেছিলাম তোমার ব্যক্তিত্বকে, তোমার ইগোকে। সেই তুমি ব্যক্তিত্বহীনের মতো আমার পিছু নাও। আমার গাড়ি ফলো করে আমার বাসা পর্যন্ত গিয়েছ। একদিন দুইদিন হলে একটা কথা ছিল। কিন্তু তুমি প্রায় প্রতিটা দিনই এই কাজ করছ। লোকে এসব দেখে, রাশেদ। আর তারা এসব ভাল চোখে দেখে না। আর আমার হাজবেন্ড সেও এটা লক্ষ্য করেছে এবং তার কাছে এই খবরটা গেছে যে তার স্ত্রীর অনেক পুরনো বন্ধু বা হয়তো প্রেমিক তার সাথে দেখা করতে চেম্বারে আসে। সেও যথেষ্ট ব্যক্তিত্ববান বলে আমাকে সরাসরি এই কথাগুলো বলেনি কিন্তু তার আচরণ, কথা বলার ভঙ্গি দেখে এটুকু বুঝতে পেরেছি যে ব্যাপারটা তার ভালো লাগছে না। সে আমাকে অনেক ভালবাসে এবং আমার খেয়াল রাখে। আমি চাই না, তার সেই ভালবাসাটা কমে যাক। আর আমাদের মধ্যে একটু দূরত্ব তৈরি হলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমাদের ছেলেটা। আর একজন মা হয়ে সন্তানের এমন ক্ষতি চাইব না। তাই তোমার কাছে অনুরোধ, তুমি প্লিজ আমার কাছে এসো না, আমাকে ফলো কর না। তোমারও তো স্ত্রী আছে, একটা মেয়ে আছে। তাদের কথা ভাবো, তুমি তো তোমার স্ত্রীকে ঠকাচ্ছ, তাই নয় কী? -হয়তো। -হয়তো আবার কী? তোমার স্ত্রীর কথা বাদ দিলাম, তোমার মেয়েটার কথা তো ভাবো। যদি তুমি এরকম উল্টাপাল্টা কর, তাহলে তোমার সংসারে সমস্যা হবে, আর তার ফলটা ভোগ করবে তোমার নিষ্পাপ মেয়েটা। তুমি নিশ্চয় তা চাও না, এই বুড়ো বয়সে কেলেঙ্কারি হোক। থামল মৌরী। শুধুমাত্র বাতাসের শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। রাস্তা দিয়ে শোঁ শোঁ শব্দ করে দু’একটা গাড়ি ছুটে চলছে। মৌরী দেখল রাশেদ যে দ্বিতীয় সিগারেটটা ধরিয়েছিল ওটা হাতেই শেষ হয়েছে। ছাইটা এখনো পড়ে যায়নি তবে যেকোনো মুহূর্তে পড়ে যাবে। মৌরী বলল, একটা কথা বল তো, তুমি এখনো আমাকে আমাকে ভালবাসো? রাশেদ বলল, হ্যাঁ। কিন্তু তার গলার স্বরটা পাল্টে গেছে। কেমনযেন ধরে আসছে গলাটা। মৌরী বলল, কতটুকু ভালবাসো? আগের মতো? -হ্যাঁ। -যাকে ভালবাসো, তার ক্ষতি চাও তুমি? -না। -যাকে তুমি ভালবাসো, তার কথাটা শুনবে না? -হুম। -তাহলে প্লিজ, এসব বাদ দাও। কী হবে রাশেদ? এসব করে কী হবে? আমার জীবনে তোমার ফিরে আসার চান্স নেই, এবং সত্যি বলতে দরকারও নেই। আর আমি মনে করি, তোমার জীবনেও আমার দরকার নেই। প্রায় নিঃশব্দে রাশেদ বলল, দরকার আছে। কিন্তু মৌরী সেই কথাটা শুনতে পাইনি। রাশেদ বলল, দেখো মৌরী, তোমাকে আমি এক ঘণ্টার জন্য, এক দিনের জন্য বা এক বছরের জন্য ভালবাসিনি। তোমাকে ভালবেসেছি সারা জীবনের জন্য। তাই এখনো বাসি। ভবিষ্যতেও বাসব। কিন্তু তোমাকে পাবো না-এটা জানি। তবুও ভালবেসে যাব। আমার জন্য তোমার যা ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করতে পারব না। কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি, তোমাকে আর কখনো কোনদিন বিরক্ত করব না। একটু প্রশ্ন করি, উত্তর দিবে? মৌরী বলল, হ্যাঁ। বল। রাশেদ মৌরীর চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, তুমি কি এখনো আমাকে ভালবাস না? মৌরী উত্তর দিচ্ছে না। সেও তাকিয়ে আছে রাশেদের চোখের দিকে। চোখের পাতা কাঁপছে তার। ঠোঁটদুটোতে ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। উত্তরটা দিতে পারছে না। ভাইভা বোর্ডে যখন কোন চাকরি প্রার্থী প্রশ্নকর্তার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না, তখন তার যেমন অবস্থা হয়, মৌরীরও একই অবস্থা। হঠাৎ রাশেদের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে মৌরী আস্তে করে বলল, নাহ। বাসি না। রাশেদ হাসছে। নিঃশব্দে হাসি। মৌরী রাশেদের চোখের দিকে তাকাতে পারছে না। তার ব্যাগটা নিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, এখন ওঠা যাক। রাশেদ একটা গানের একটা লাইন গাইল, আরও কিছুক্ষণ কি রবে বন্ধু? আরও কিছু কথা কি হবে? গানের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসল। রাশেদও গাড়িতে উঠে পড়ল। এই ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইল দু’মগ কফি। রাশেদ গাড়িতে উঠে রেডিও ছাড়ল। কী কাকতালীয় ব্যাপার! রাশেদের সবচেয়ে প্রিয় গানটাই বাজছে, O light the candle, John The daylight has almost gone The birds have sung their last The bells call all to mass. সারাটা পথ দুজনের কেউ কোন কথা বলল না। এমনকি মৌরী গাড়ি থেকে নামার সময় মৌরী বা রাশেদ কেউই বলেনি ‘ভালো থেকো’। মাসখানেক পরের কথা। সেদিনের পর থেকে রাশেদ কখনো মৌরীর চেম্বারে আসেনি। বরং রাশেদ না আসাতে মৌরীর খারাপ লেগেছে। তবে ধীরেধীরে সে রাশেদের ব্যাপারটা মাথা থেকে বাদ দিতে সক্ষম হয়েছে। ঠিক তখনি এক রোগী এলো মৌরীর কাছে। রোগীকে দেখা শেষ হওয়ার পর সাধারণত উঠে চলে যায়। কিন্তু এই রোগী চলে না গিয়ে বসে রইল। তারপর বলল, আমি সম্ভবত আপনাকে চিনি। মৌরী অবাক হয়ে বলল, চেনেন মানে? আমাকে আগে কোথাও দেখেছেন? যেহেতু ডাক্তারি করি, হাসপাতালে চাকরি করি, দেখে থাকতে পারেন। -না। হাসপাতালে না। আপনাকে দেখেছি একজনের অতীতে। তার গল্পে, তার স্মৃতিতে। সেখানে আপনি ডাক্তার না, একজন প্রেমিকা। -কী বলতে চাচ্ছেন? -আমি যদি ভুল না করি, আপনি মৌরী। রাশেদ নামে কাউকে চেনেন বা চিনতেন? মৌরী যা এতদিন ধরে ভোলার চেষ্টা করছে, এই লোকটা তা মনে করিয়ে দিচ্ছে৷ মৌরী বলল, হ্যাঁ। চিনি। -রাশেদ আপনার কথা এতই বলে যে মাঝেমধ্যে রাগ হত, বিরক্ত হয়ে যেতাম। এক পর্যায়ে ভাবলাম, যদি কোনদিন মৌরীর দেখা পায় একটা কথা বলব। -কী কথা? -আপনি একটা কোহিনূর হীরা হারিয়েছেন। কেউ যে একটা মেয়েকে বিশ-একুশ বছর ধরে কিভাবে ভালবেসে যায়। যার জন্য বিয়েটা পর্যন্ত করেনি। অনেক টাকাপয়সা পয়সা জমিয়েছে। কিন্তু ওসব কে খাবে? ওকে কত বোঝালাম যে, বিয়েটা করে সংসারী হ। কিন্তু কে শোনে কার কথা? করলই না। মৌরীর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। সে ড্রয়ার থেকে রাশেদের দেওয়া কার্ডটা বের করতে করতে বলল, ও তো বলেছে ও বিয়ে করেছে। কার্ডটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ওর মেয়ের নামে কোম্পানি দিয়েছে। লোকটা হেসে বলল, কোম্পানিটা ওর মেয়ের নামে না, আপনার নামে। আর ও মেয়ে পাবে কোথায়? বিয়েই তো করেনি। আপনার সাথে ওর দেখা হয়েছিল? -হ্যাঁ। কিছুদিন আগে হঠাৎ আমার চেম্বারে এসেছিল। বেশকিছু দিন দেখা হল। পরে ওকে বুঝিয়ে বললাম যে দেখা করাটা আমার জন্য ক্ষতিকর হয়ে যাচ্ছে। তখন ও বলেছিল যে বিয়ে করেছে। একটা মেয়ে আছে। আমার নামেই মেয়েটার নাম রেখেছে। -আপনাকে মিথ্যা বলেছে সে। আমি গত দুই মাস ব্যবসায়ের কাজে সিঙ্গাপুর গেছিলাম। ও হ্যাঁ, আমার পরিচয়টাই তো দেওয়া হয়নি। আমি সুলতান মাহমুদ। মৌরী আবার চমকালো। ওদের সম্পর্কের সময় রাশেদের মুখে একটা ছেলের নাম বেশি শুনত। আর সে হচ্ছে ‘সুলতান মাহমুদ’। মৌরী বলল, আপনার কথা ওর মুখে অনেক শুনতাম। -আর আমরা এখন একসাথে ব্যবসা করি। যাইহোক, ভালো লাগল আপনাকে দেখে। ভালো থাকবেন। আমার একটা মিটিংয়ে জয়েন করা লাগবে। তাই উঠছি। সুলতান মাহমুদ চলে গেল। মৌরী জানালার দিকে তাকিয়ে আছে নিশ্চুপ হয়ে। এতটাও ভালবাসা যায়? সিনেমায় দেখেছে এরকম। আর তাকেই কেউ সেই সিনেমার নায়কের মতো ভালবাসে?

হলো না পাওয়া তোকে

জানুয়ারী ১৫, ২০২০ 0
হলো না পাওয়া তোকে
উফফ, অসহ্য, সন্ধ্যায় এতটা বাজে পরিস্থিতিতে পরবে, কখনো ভাবেও নি মাহমুদা, হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো, রাস্তা থেকে একপ্রকার দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে ই পাশের একটা টং এর দোকানে গিয়ে দাঁড়ালো সে, ইতিমধ্যে সেখানে আরো লোকজন জড়ো হয়েছে বৃষ্টি থেকে একটু বাঁচার আশায়। . কয়েকটা ছেলে এসে মাহমুদার ভিজা শরীরের দিকে তাকিয়ে মজা নিচ্ছে। . মাহমুদা তার হাজব্যান্ড কে ফোন দিচ্ছে বারবার।ধরছে না কেটে দিচ্ছে। একরাশ বিরক্তি মুখে নিয়ে মনে মনেই সে উচ্চারণ করল স্টুপিড, কেয়ারলেস। . খিট খিটে মেজাজ ঠান্ডা করার কোনো উপায় পাচ্ছে না মাহমুদা।বাজে ছেলে গুলো গায়ের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আবারও সে কল দিলো তার হাজবেন্ড কে।কল ওয়েটিং!! কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা সে।হঠাৎ মাহমুদা খেয়াল করলো এই ঝড় তুফানের মাঝেও একটা ছেলে ভবঘুরের মত ভিজে ভিজে আসছে।এটা দেখে মাহমুদার কলেজ জীবনের কথা মনে পড়ে যায়।তার ও বৃষ্টিতে ভেজার লোভ হয় খুব।কতো দিন মন খুলে বৃষ্টিতে ভেজা হয়না তার।কিন্তু এই শাড়ী – হাই হিল পরে কেউ বৃষ্টিতে ভিজলে সেটা কেমন যেনো হয়ে যাবে।ছেলেটার দিকে তাকিয়েই থাকতে থাকতেই এসব ভাবে সে।এদিকে হাঁটতে হাঁটতেই ছেলেটা খেয়াল করে একটা অপ্সরীর মত সুন্দর মেয়ে তার দিকে হা হয়ে তাকিয়ে আছে।ছেলেটা তখন আর মন খুলে ভিজতে পারেনা। মন খুলে বৃষ্টিতে ভিজতে হয় লোকচক্ষুর আড়ালে।বৃষ্টিতে ভেজার সময় কেউ হা করে তাকিয়ে থাকলে সেটা যে কত বিরক্তিকর তা যে ভেজে সেই কেবল বুঝে, ছেলেটাও ভেজা বাদ দিয়ে টং দোকানে এসে দাঁড়ায়, লজ্জায় মেয়েটার দিকে একবার ও আর তাকায় না। মাহমুদা তার কিশোরীবেলার স্মৃতি থেকে বাস্তবে ফিরে গাড়ির হর্ণ এর আওয়াজে।একজন সুটেট বুটেট লোক গাড়ির দরজা খুলে একরাশ বিরক্তি মুখে নিয়ে মাহমুদার দিকে তাকিয়ে ধমকের স্বরে বলে ভিতরে আসোহ।শাড়ি- হাই হিল পরে মাহমুদা টং দোকান থেকে বৃষ্টির ভিতর দিয়ে হেঁটে গিয়ে গাড়িতে উঠে।ওঠার সময় খেয়াল করে ভবঘুরে ছেলেটা তাকিয়েই আছে তার দিকে এখনো। . সাঁই সাঁই শব্দ করে পানির বুক চিরে চলে যায় গাড়িটা।ছেলেটাও আবার বৃষ্টির মাঝে হাঁটা শুরু করে। ___________________________ মাহমুদা গাড়িতে বসে ফোন হাতে নেয়। অনেক আগের মুখস্ত করা নাম্বার,একটু কষ্ট করে মনে করে।তারপর , টপাটপ ডায়াল করে, একটা মেসেজ পাঠায়, ” আগের মতই রয়ে গেছো তাই না?? তাড়াতাড়ি বাসায় গিয়ে গোসল করো।নাহলে ঠান্ডা লেগে যাবে।জ্বর আসবে ” ছেলেটা মেসেজের শব্দ পায়, পকেট থেকে মোবাইল বের করে,স্ক্রীনে জ্বল জ্বল করতে থাকা প্রিয় নামটা আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে আসে বৃষ্টির পানির ফোঁটায়, ৮ বছর আগেও, এভাবেই নামটা আবছা হয়ে এসেছিলো ছেলেটির চোখের পানিতে, আজ চোখে পানি আছে?? হয়ত নেই, আবার হয়ত বৃষ্টির পানির সাথে মিশে গেছে তাই বোঝা যায় না। ৮ বছর আগে,মাহমুদার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আর যোগাযোগ করেনি হাসিব। বিরক্তি বোঝাই করা সংসার হলেও কোনরকম চলে যাচ্ছে মাহমুদার জীবনগাড়ি, কোন এক হঠাৎ সন্ধ্যায় আবার তাকে দেখা!! . থেমে নেই সময়।কখন যে আট টা বছর কেটে গেলো!! ভেবেই আবার ঝুম বৃষ্টিতে, রাস্তার পাশ ধরে হাঁটতে হাঁটতে চোখের আড়াল হয়ে যায় ছেলেটি। লেখক : আসাদ রহমান কোটচাঁদপুর,ঝিনাইদহ

অভিশপ্ত প্রেম/Asad Rahman

জানুয়ারী ১৫, ২০২০ 0
অভিশপ্ত প্রেম/Asad Rahman
শিশির বিছানায় জীবন বিশ্বাসঘাতকতা   শহীদদের হত্যা করার জন্য মাটি লাল হয়ে গেছে,   অন্তরে অবাধ্য প্রেম জেগে ওঠে   সংক্রামিত ভ্রূণের কাছে স্বাধীনতার বীজ বপন করুন।   অভিমানী মা আজ অজ্ঞান হয়ে কাঁদছেন   স্বাধীনতার নীচে নিমজ্জন কি অপ্রয়োজনীয়?   ফাগুনের আগুনে মাটি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে   অকাল মৃত্যুর নীতিমালা!   স্বপ্নের রঙ ফিকে হয়ে যায়   শাপালা দোয়েল অন্যায়ভাবে কেঁদেছিলেন,   সুশাসনের স্বাদ নেই; তারা মুগ্ধ করে তাদের গ্রাস করে   গনচিল ও ইলিশের ঝাঁক প্যাডেলে আসেনি   মহাজন অহংকার করে সুখের দলে   প্রভুকে উপেক্ষা করা, নিন্দার প্রতি অন্ধ হতে,   এই প্রথাতে এখন অনিয়ম নিয়ম   খোঁড়া জাতির দেশ আমার কাঁপতে ভয় পাচ্ছে!   মানুষ যদি মানুষকে বিশ্বাস না করে, ঘৃণা ঘৃণা বাড়ে   সুখের অভিব্যক্তিতে সত্য বোঝার দরকার নেই!   জাতি সর্বদা অশ্লীলতার অভিশাপে কেঁদেছিল   জীবনে কেউ কী করবে এবং বিপর্যয় ডুবে যাবে?

জল-শব্দ /Asad Rahman

জানুয়ারী ১৫, ২০২০ 0
জল-শব্দ /Asad Rahman
মুঠোতে ধরে রাখি শব্দঘর এপাশের টুকিটাকি বিস্ময় ভেসে যায় অন্য পাশ… জানি, শব্দেরো থাকে ঘ্রাণ! পশ্চিমের জলমরা বর্ণমালায় ফোটে ঊনপঞ্চাশী বাগানবিলাস… ধ্বনিও ডেকে তুলে ডুবন্ত অন্তঃপুর ভালবাসা নড়ে অক্ষরের আয়নায় শব্দও হয় নারী এবং পুরুষ… যন্ত্রের বুকেও জন্ম নেয় জলহাওয়া যান্ত্রিক আকাশেও ভারী মেঘ হয় অতলস্পর্শী বৃষ্টিতে ভিজে শব্দের নিঃশ্বাস। একদিন দেখা হবে! মুখোমুখি হবে কথা! ভাষার পৃথিবীতে বাক্যে হবে জলাশয় একদানা শব্দ ঠোঁটে, অপেক্ষায় একজোড়া সারস। শুধু অন্তঃস্থ আলাপে, থমথমে দূরত্ব গভীর নিয়তির জলপথে দুর্দান্ত জটিলতা সাঁতরে বেড়ায় তবু সরু স্বপ্ন হাঁটে স্রোতের চারপাশ। তবু একদানা-শব্দ ‘ভালবাসা’ আজও প্রবল থাকবে আগামীকালও!