বুধবার, ২৮ আগস্ট, ২০১৯

বেলাশেষে

#বেলাশেষে♥ (১ম-পর্ব) মোঃ আসাদ রহমান কোটচাঁদপুর,,ঝিনাইদহ মাত্রই বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছি। আসলে বউ নয়, আমার মেয়ের জন্য মা এনেছি। শুনেছি মেয়েটি ডিভোর্সি। সে যেমনই হউক তাতে আমার কোন আগ্রহই ছিল না। আমি এত খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজনই মনে করিনি। আমার তো বউয়ের দরকার ছিল না, ছিল আমার আয়শার জন্য একজন মায়ের। আমার বৃদ্ধ মায়ের আকুতি ফেলতে পারিনি বলেই বিয়ের পীড়িতে বসতে হল। আমার তাসনিকে ভুলে অন্য কাউকে আপন করে নেওয়া আমার পক্ষে কখনোই সম্ভব ছিল না। তাসনি আমার হৃদয়ের ঠিক কতখানি জায়গা জুড়ে আছে আমি কাউকে বুঝাতে পারব না। মায়ের জেদের কাছে হার মেনেছি। আয়শার বয়স প্রায় পাঁচ রানিং , মায়ের কথা ছিল "আমি মারা গেলে তোর তাসনির স্মৃতিকে কে আগলে ধরবে? তুই তো সারাদিন অফিসে থাকিস, আয়শার যত্ন কে নিবে। একবার তো মরতে মরতে বেঁচে গেছি আবার যে বেঁচে ফিরব তার কোন নিশ্চয়তা নেই" মা'ই মেয়ে দেখে ঠিক করে রেখেছিল। মেয়েটির কেন ডিভোর্স হল সেটাও জানার চেষ্টা করিনি। শুনেছি মেয়েরা বাচ্চা না হলে স্বামীর আগের বউয়ের বাচ্চাদের ভালোবাসে। আমি তাকে বাচ্চা নেওয়ার সুযোগই দিব না। তাহলে হয়তো আমার আয়শা মায়ের যত্ন পাবে। জানি, হয়তো আয়শা বড় হলে আমাকে ভুল বুঝবে। কেন তার মায়ের জায়গা অন্য কাউকে দিলাম? মেয়েটির নাম মেইরি, তাও জেনেছি আয়শার কাছ থেকে। সেদিন বিয়ে করে এসে রুমে তাসনির কাপড়, তাসনির জিনিস ধরে খুব কান্না করছিলাম। খুব মনে পড়ছিল তাসনি সাথে কাটানো মুহুর্তগুলো। আয়শা যখন পেটে আসে, তখন তাসনি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল, সবসময় ওর মুখে একটাই কথা থাকতো, আমার বাচ্চাটিও যেন আমার মত মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত না হয়। তাসনির মাও ছোট বেলায় মারা যায় সৎ মায়ের হাতেই মানুষ। আমি তাকে যতই আশ্বস্ত করতাম তোমার কিচ্ছু হবে না, আমি আছি তো। সে কিছুতেই মানতো না, তাসনির বার বার মনে হতো সে বাঁচবে না। একবার বলেছিল, --আমি যদি মারা যায় তুমি আবার বিয়ে কর কিন্তু আমার বাচ্চাটিকে দেখে রেখ। ওকে কোন কষ্ট পেতে দিও না। প্রয়োজনে হোস্টেলে রেখে লেখাপড়া করাইও তাও ওকে কষ্ট পেতে দিও না। তোমাকে বিয়ে করতে বারণ করব না। গুনাহের পথে যাওয়ার চেয়ে বিয়েটা অনেক গুণ উত্তম। তুমি গুনাহগার হলে আমরা জান্নাতে একসাথে কীভাবে থাকব? আমি যে তোমায় ছাড়া জান্নাতে যেতে চাই না। বিশ্বাস কর, আমি ভাবতে পারছি না তোমার বুকে অন্য কারো স্থান। তুমি অন্য কাউকে আমার মত করে ভালোবাসবে। সেদিন আমি বিয়ের সাত বছরের মাথায় প্রথমবারের মত তাসনিকে মারতে হাত তুলেছিলাম কিন্তু মারিনি। পর মুহুর্তেই ওকে জড়িয়ে ধরে খুব কান্না করেছিলাম। বলেছিলাম, : আর কখনো এমন কথা বললে আমি ঘর ছেড়ে চলে যাব। কেন এমন কথা বল? দেখ, আমাদের মেয়ে হবে, ওর নাম রাখব তোমার পছন্দের নামে আয়শা। আমি আর তুমি একসাথে বড় করে তুলব, আমাদের মনের মত করে। আর শুন মেয়ে, আমার বুকে শুধু একজনই মাথা রাখতে পারবে। এই বুকে তাসনি ছাড়া অন্য কারো স্থান নেই। এই বুকে তো নয়ই এই রুমেও অন্য কারো জায়গা হবে না। সেদিন কে জানত, তাসনি আমাকে ছেড়ে সত্যি চলে যাবে। তাসনিকে দেওয়া কথা সম্পূর্ণ রাখতে পারিনি। তাসনির রুমে অন্য কাউকে জায়গা দিতেই হল। যদিও আমি অন্য রুমে চলে গেছি। কিন্তু সে কখনো আমার বুকে জায়গা পাবে না। কখনো নয়। বিয়ের রাতে যখন তাসনির কাপড় জড়িয়ে নিয়ে অঝরে চোখের পানি ফেলছিলাম। আয়শা এসে বললো, : বাবা, ওই যে বউ টা, বউটা আমাকে কোলে নিয়ে খুব আদর করেছে। বউটা খুব ভাল। আমাকে অনেক চকলেট দিয়েছে। জান বাবা? বউটার নাম মেইরি। বউটা না বসে বসে কাঁদছে! বাবা, মাও কি এভাবে কাঁদতো? বাবা, আমি বউটাকে কি বলে ডাকব? দাদু বলেছে মা বলে ডাকতে। তাহলে মা খুশি হবে। আচ্ছা বাবা আমি তাকে মা বলে কেন ডাকব? মা তো আল্লাহর কাছে চলে গেছে। বল না বাবা আমি ওকে কি ডাকব? ও বাবা বল না কী বলে ডাকব? আমার ছোট্ট মা'টা এমনভাবে কথা বলে কলিজাটা ছিঁড়ে যেতে চায়। আমার কাছে এর কোন উত্তর ছিল না। সে কেন আমার আয়শার মা হবে? তার সে যোগ্যতাই নেই। আয়শাকে কোন উত্তর না দিয়ে কোলে নিয়ে বললাম, --মা, তুমি ভাত খাবে? চল ভাত খাইয়ে দিই। খুদা,,, আমার কথা শেষ কর‍তে না দিয়ে আয়শা বললো, : না বাবা, দাদু বলেছে আজ আমাকে ওই যে বউটা মেইরি, সে ভাত খাইয়ে দিবে। আমি আর কিছু না বলে চুপ করে রইলাম। আয়শা এক দৌড়ে মায়ের রুমে চলে গেল। মা আয়শাকে দাদুভাই বলে কোলে তুলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলো। তাসনি মারা যাওয়ার পর আয়শাকে নিজের সন্তানের মতো লালন পালন করেছে মা। যতক্ষণ বাসায় থাকি ততক্ষণ আয়শাকে সাথে রাখতে পারলেও রাতে মা কখনো আমার কাছে দিত না। বলতো, --তুই আমার দাদুমনিকে ঠিকমতো খাওয়াতে পারবি না। মা রাত জেগে, পানি ঠান্ডা করে আয়শাকে ফিডার খাওয়াত। এখনো ভাত খেতে না চাইলে ছাদে গিয়ে কাক দেখিয়ে দেখিয়ে খাবার খাওয়ায়। জানি মায়ের এই বয়সে কষ্ট হয় কিন্তু আমার কাছে কোন অপশন ছিল না। তাসনির জায়গা অন্য কাউকে দেওয়া সম্ভব নয়। অন্য কেউ আসলেই যে আয়শাকে ভালোবাসবে তা তো নয়। আমার বড় ভাই আলাদা বাসায় থাকে। উনার তিন ছেলে কোন মেয়ে নেই৷ ভাবি একটা মেয়ের জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছিল। তাসনি মারা যাওয়ার পর বড়ভাবী একবার আয়শাকে একেবারে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। আমি কিছু বলার আগেই মা, ভাবী আর ভাইয়ার সাথে ঝগড়া বেধে দিয়েছিল। সেদিন থেকে ভাবীকে আমার দুশমন মনে হয়। মাঝেমাঝে আপুরা অভিমান করে বলে, মায়ের কাছে আয়শার চেয়ে আপন কেউ নেই। আয়শা মায়ের ৫ম সন্তান। সত্যিই আয়শা মায়ের কাছে তার চার সন্তানের চেয়ে বেশি আদরের। সেই আয়শাকে মেইরি নামক সৎ মা যদি কষ্ট দেয়!? আয়শার জন্য মেয়েটাকে বিয়ে করে কি লাভ? এসব যখন ভাবছিলাম, মা এসে দরজায় দাঁড়াল সাথে মেইরি আর মায়ের কোলে আয়শা। আজ থেকে মেইরি এখানেই থাকবে। ঠিক আছে তোমরা এখানে থাক বলে আমি রাগ করে ছাদে চলে গেলাম। আমি মা'কে আগেই বলেছিলাম সে অন্য রুমে থাকবে তবে কেন মা ওকে আমার তাসনির রুমে নিয়ে এল। মা তো আমার মনের অবস্থা বুঝে। আমার মন খারাপ হলেই ছাদে চলে আসি। ছাদে একটা দোলনা আছে। আমি আর তাসনি এই দোলনায় কত স্মরণীয় মুহুর্ত কাটিয়েছি তা কখনো ভুলার নয়। তাসনি বসে থাকতো আমি ওর কোলে মাথা রেখে আকাশ দেখতাম আর তারা গুণতাম। তাসনি এক মুখ হাসি নিয়ে রাজ্যের গল্প করতো। আর মাথায় ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে দিত। অনেক সময় রাত্রি বেলায় বৃষ্টি পড়তো আর তাসনি দু হাত মেলে দিয়ে বৃষ্টির মজা নিত। জ্যোৎস্নার আলোয় তাকে আরো বেশি মোহনীয় করে তুলত আর আমি তাকে প্রাণ ভরে দেখতাম। কখনো দেরী হলে মিছে অভিমানে গাল ফোলাতাম আর তাসনি শত আদরে আমার মান ভাঙাতো। সেসব কী আর কারো সাথে কখনো সম্ভব? কখনোই নয়! এসব ভাবতে ভাবতে কখন চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল নিজেই টের পাইনি। জানি না এভাবে ছাদে কতক্ষণ চোখের জল ফেলছিলাম হঠাৎ হাতে নরম কারো হাতের স্পর্শে চমকে উঠলাম। এমনভাবে তাসনির কল্পনায় ছিলাম, বলে উঠলাম, --তাসনি তুমি এসেছ? এত দেরী করলে যে? যেমনভাবে আগে অভিমান করতাম ঠিক সেভাবেই কথাটা বললাম। : আমি তাসনি নয়, আমি চমকে ফিরে তাকালাম।

কোন মন্তব্য নেই: